শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৯:৫৩ pm
একজন যুবক যৌবনের উদ্দাম সময়ে চাইলেই অনেক পাপে জড়াতে পারে; কিন্তু তা না করে সে যদি আল্লাহর ইবাদতে মনোযোগী হয়, পাপমুক্ত জীবন গড়ে এবং জীবনকে বিশুদ্ধতায় পরিশীলিত করার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে, সে আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হয়।
একটি সুন্দর ইসলামি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-কে সঙ্গ দিয়েছিলেন একঝাঁক তরুণ-যুবক। তাঁরা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে মহানবী (সা.)-কে সব ধরনের সহযোগিতা করে গেছেন। যুবসমাজের সহায়তায় নবুয়তপ্রাপ্তির আগ থেকেই তিনি মানবমুক্তির সংঘবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হন। আর এ কথা সত্য যে কোনো কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীকে উৎখাতের মাধ্যমে একটা সুশীল সমাজ গড়তে সর্বাগ্রে প্রয়োজন যুবসমাজের সংঘবদ্ধতা। কেননা, যুবকেরাই পারে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে কালো রাজপথ রাঙিয়ে তুলতে। সীমাহীন ত্যাগ-কোরবানির মাধ্যমে সমাজসংস্কারে ব্রতী হতে। তারাই পারে ঘুণে-ধরা শোষিত সমাজকে ভেঙেচুরে সুন্দর সমাজ উপহার দিতে। কারণ, যুবসমাজের হৃদয়ে বাস করে সত্য-সুন্দরকে ভালোবাসার সুতীব্র বাসনা। আছে সোনালি ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের স্বপ্ন। যে স্বপ্ন তাদের পিছুটানকে প্রতিনিয়ত ভুলিয়ে দেয়। তাই তো মহানবী (সা.) যুবসমাজকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘রোজ হাশরের ময়দানে যাঁরা আল্লাহর আরশের ছায়াতলে মেহমান হবেন তাঁদের মধ্যে একটি দল তাঁরা, যাঁরা আল্লাহ নির্দেশিত পথে যৌবনকাল কাটিয়ে দিয়েছেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৬৬০) তিনি আরও বলেন, ‘হাশরের ময়দানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে যে পাঁচটি বিষয়ে হিসাব দিতে হবে, সেগুলোর অন্যতম হলো—তুমি তোমার যৌবনকাল কীভাবে অতিবাহিত করেছ।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৪১৭) একজন বৃদ্ধের ইবাদতের চেয়ে ওই যুবকের ইবাদত আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দনীয়, যে নিজের যৌবন যথার্থভাবে ব্যয় করতে শিখেছে। একদিন মহানবী (সা.) আবেগমথিত হয়ে খানিক পরিতাপের সুরে বলেন, ‘যুবকেরাই আমাকে সহায়তা করেছে আর বৃদ্ধরা আমাকে কষ্ট দিয়েছে।’ তাই বলা যায়, যৌবনকাল অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও মূল্যবান। যৌবনকালকে যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে পরম সুখ ও শান্তি লাভ করা যায়। পক্ষান্তরে যৌবনের অবহেলায় রয়েছে চরম ক্ষতি ও ব্যর্থতা।
মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত বিশ্বের সব যুবকের জন্য উত্তম আদর্শ। যৌবনকালে তিনি আপন পিতৃব্যের সঙ্গে ফুজ্জার যুদ্ধে গিয়ে নৃশংস-নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখে বিচলিত হয়ে ওঠেন। তাঁর হৃদয়ে এই অনাচার মূলোৎপাটন করার এক অদম্য স্পৃহা জাগ্রত হয়। তা বাস্তবায়নে মহানবী (সা.) বিভিন্ন গোত্রের নেতাদের সহযোগিতা কামনা করেন। তাঁদের সমন্বয়ে বিরাজমান অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি প্রণয়ন করে গঠন করেন বিপ্লবী শান্তিবাহী সংগঠন হিলফুল ফুজুল। সেই সংগঠনের কর্মসূচিতে আজকের যুবসমাজের জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষা। তরুণ মুহাম্মদ (সা.)-এর এই পদক্ষেপ ঐক্যবদ্ধ জাতি ও সুসংহত রাষ্ট্র গঠনে কতটা কার্যকর ছিল, তা বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত করবে। তাঁর এই সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে যাঁরা বিশেষ অবদান রাখেন, তাঁরাও ছিলেন টগবগে দুই যুবক। একজন আপন পিতৃব্য জুবায়ের বিন আবদুল মুত্তালিব অপরজন হলেন ইবনে জুদআন।
মানবতার মুক্তির অগ্রসৈনিক মুহাম্মদ (সা.) যুবসমাজকেই ইসলামি সমাজ বিনির্মাণের বীর সেনানী হিসেবে গ্রহণ করেন। কারণ, যুবসমাজের সামর্থ্য-শক্তি ও শৌর্য-বীর্যের মনোভাব তিনি ভালোভাবেই জানতেন। তাই তো দেখা যায়, ইসলামের প্রতিষ্ঠাকালে যাঁরা তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে হজরত আলী (রা.), হজরত জুবায়ের (রা.), তালহা (রা.), সাদ ইবনে উবাদাহ (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর মতো ব্যক্তিত্ব ইসলাম গ্রহণকালীন ২০ বছরের কম বয়সের টগবগে তরুণ ছিলেন। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ও হজরত বেলাল (রা.)-এর বয়স ছিল ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। হজরত আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.), জায়েদ ইবনে হারিসা (রা.), হজরত ওসমান (রা.) ও হজরত ওমর ফারুক (রা.) ছিলেন ৩০ থেকে ৩৫ বছরের যুবক। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর বয়সও ছিল মাত্র ৩৮ বছর।
পবিত্র কোরআনের সুরা হজের ২৯ নম্বর আয়াতের মাধ্যমে মুসলমানদের যখন কাফেরদের অনাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়, তখন যাঁরা মহানবী (সা.)-এর ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে ইস্পাতসম দৃঢ়তার সঙ্গে বীরদর্পে লড়াই করেন, তাঁদের সিংহভাগই ছিলেন যুবক। এ ছাড়া তাঁর অবর্তমানে তাঁর হাতে গড়া সাহাবিদের মধ্যে যাঁরা রোম, পারস্য ও মিসরের বুকে ইসলামের নিশান উড্ডীন করেছিলেন, সেই বীরকেশরী খালিদ সাইফুল্লাহ (রা.), সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.), আমর ইবনুল আস (রা.) এবং তাঁদের সঙ্গী-সাথিরা আপন যৌবনের প্রকাশ ঘটিয়েই অর্ধজাহানকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে নিয়ে এসেছিলেন।
একটি কথা মনে রাখতে হবে, একজন যুবক যৌবনের উদ্দাম সময়ে চাইলেই অনেক পাপে জড়াতে পারে; কিন্তু তা না করে সে যদি আল্লাহর ইবাদতে মনোযোগী হয়, পাপমুক্ত জীবন গড়ে এবং জীবনকে বিশুদ্ধতায় পরিশীলিত করার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে, সে আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হয়। তার ইহকালীন জীবন হয় কণ্টকমুক্ত আর পরকালীন জীবন হবে শঙ্কামুক্ত। এমন ব্যক্তির ব্যাপারেই মহান আল্লাহ বলেছেন—‘তাদের না থাকবে কোনো ভয়, না থাকবে কোনো দুশ্চিন্তা।’ মহানবী (সা.) এমন যুবকদেরই জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অতএব যুবকদের আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মনোযোগী হতে হবে কিশোর বয়স থেকেই। আর আল্লাহর নির্দেশিত পথের একনিষ্ঠ সৈনিক হিসেবে যৌবনকাল অতিবাহিত করতে হবে। কেননা, বিশ্বের বিবর্তন-পরিবর্তন ও সমাজসংস্কারে যুবকদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.) সমাজসংস্কারের নিমিত্তে হিলফুল ফুজুল গড়েছিলেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে। হজরত আলী (রা.) মহানবী (সা.)-এর সাহচর্যে যোগ দিয়েছিলেন মাত্র ১০ বছর বয়সে। নেপোলিয়ন ইতালি জয় করেছিলেন মাত্র ২৫ বছর বয়সে। আর আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। যুবকদের এমন কৃতিত্বের নজির পৃথিবীতে অসংখ্য।
মহান আল্লাহ যুবসমাজকে নিজেদের সামর্থ্য-মর্যাদা বোঝার এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক তা অতিবাহিত করার তওফিক দিন। আমিন।
ড. মো. আবদুল কাদির: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়