শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:২৮ am
বাঙালি সমাজ এখনো মনে করে, ইংরেজি না জানলে বিশ্ব ভ্রমণ করা যায় না, শুধু মাতৃভাষা দিয়ে ভিন দেশের অলিগলি ঘুরে দেখা কল্পনাতীত বা ভিন দেশে গিয়ে দরদাম করে পণ্য কেনা দুরূহ ব্যাপার। ইংরেজি জানা দূরের কথা প্রান্তিক মানুষ যারা ইংরেজিতে কথোপকথন কখনো শুনেননি তাদের কেউ ভিন দেশে ঘুরতে যাবেন একা একা- এটা আমাদের সমাজে ভাবাও যায় না। আসলে বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাস্তবে তা নয়।
আজকাল বিশ্ববাসী মাতৃভাষা দিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশ থেকে দেশ। ইংরেজি ভাষা না জানায় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না নতুন দেশের নতুন শহরে ঘুরতে। আমাদের পাশের দেশ ভারতের তামিলদের কথাই যদি বলি- তাদের অনেকেই তামিল ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানেন না, বোঝেন না। এমনকি তাদের স্বদেশ ভারতের জাতীয় ভাষা হিন্দিও তাদের বোধগম্য নয়। তাদের অধিকাংশ নাগরিক হিন্দি বোঝেন না, জানেন না। শুধু মাতৃভাষা তামিলই একমাত্র সম্বল। তারপরও তাদের বিশ্ব ঘুরতে দেখা যায়। সপরিবারে ভিন দেশের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়। তারা দলে দলে বিদেশে ঘুরতে যায়।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যারা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিল্পোন্নত, তাদের নাগরিকদের মধ্যেও দেখেছি কেউ কেউ ইংরেজি জানেন না। ইংরেজি না জানা তাদের ভিনদেশ ভ্রমণে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন সব কাঙ্ক্ষিত দেশে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
আমরা এটা বলছি না, বৃহত্তর পরিসরে ভাব বিনিময়ের জন্য ইংরেজি শেখা-জানার দরকার নেই। অবশ্যই দরকার আছে। ইংরেজি বা অন্য ভাষা শেখা ও জানায় একজন মানুষের যোগ্যতা বাড়ায়। ভিন দেশির সাথে মনখুলে কথা বলা সহজ হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাব-বিনিময়ে সামর্থ্য বাড়ায়। ভাব-বিনিময়ে প্রাণচাঞ্চল্য বজায় থাকে। তবে ইংরেজি বা অন্য ভাষা না জানলেও যে বিশ্ব ভ্রমণ করা যায় সে কথাটাই তুলে ধরার প্রয়াস এই গদ্যে।
মাতৃভাষার এতো জোর- জাপান, কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, ফ্রান্স, স্পেনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের মধ্যে অনেক মানুষকে দেখেছি তারা তাদের মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা জানেন না; এমনকি টুকটাক ইংরেজিও না। শুধু মাতৃভাষা দিয়েই তারা ঘুরে বেড়ান দেশে দেশে। ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা না জেনেও কোনো কোনো পুরুষ মানুষ ভিন দেশে গিয়ে নানা রসালয়ে ঘুরেফিরে রসাহরণ করে আসেন; এটাও এক মজার ব্যাপার। দেহ-মনের চাহিদার ব্যাপারে মূলত একই মনোভাব ও প্রকাশ ভঙ্গি জগৎবাসীর।
আমরা তখন কুয়ালালামপুরের বহু রঙে রঙিন চায়না টাউনে দোকান করি, পৃথিবীর নানা দেশের নানান জাতের নারী-পুরুষের কাছে দরদাম করে পণ্য বিক্রয় করি। একবার দুই জাপানি তরুণ-তরুণী ক্রেতা এসেছেন দোকানে। সম্ভবত ২০১৫ সালে। তারা একটা হাতব্যাগ পছন্দ করে দাম জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখি মুঠোফোনের বাটনে টিপছেন জাপানি ভাষা। সাথে সাথে অনুবাদ দেখাচ্ছে ‘দাম কত’? আমিও ক্যালকুলেটর চেপে দাম দেখালাম।
দাম বেশি বলায় তারা চলে যাচ্ছেন দেখে বললাম, কত হলে নেবেন? তারা আবারো মুঠোফোনে অনুবাদ করে দেখালো তাদের প্রত্যাশিত মূল্য। আমি আমার মূল্য থেকে আরেকটু কমিয়ে দেখালাম, যা তাদের প্রত্যাশিত মূল্য থেকে অনেক বেশি। তখন তারা চলে যাচ্ছিলেন। আমি আরও কমিয়ে দিলাম দাম। তখনো তারা মুঠোফোন চেপে দেখালেন- সরি, এখন টাকা নেই, পরে আসবো।
সব কথাই তারা বলেছেন মুঠোফোনে অনুবাদ করে ও ইশারা-ইঙ্গিতে। শুধু একবার নয়, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের বহু পর্যটককে দেখেছি ইংরেজি জানেন না মোটেও। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও সপরিবারে ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন দেশে; তাদের মধ্যেও অনেকে মাতৃভাষা আরবি ছাড়া আর কোনো ভাষায় আলুপোড়া খাবে নাকি কচুপোড়া খাবে কিছুই বলতে পারেন না।
ইংরেজি বলতে ‘ইয়েস’ ‘নো’ ‘গুড’ এইটুকুই জানেন কেউ কেউ। তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা দিয়েই তারা নানান ভাষার নানা দেশ ঘুরে-ফিরে, কেনাকাটা করে বস্তা ভরে। ভিন দেশে গিয়ে আরবি ভাষায়ই পণ্যের দাম নিয়ে কেউ কেউ রাজ্যের তর্কাতর্কিতে মেতে ওঠেন। বিক্রয়কর্মী বেচারা কিছুটা বোঝেন কিছুটা বোঝেন না। তারপরও যথাসাধ্য চালিয়ে যান বিদেশি ক্রেতার মন জয়ের চেষ্টা। তার তো বেচা দরকার যেভাবেই হোক।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যারা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিল্পোন্নত, তাদের নাগরিকদের মধ্যেও দেখেছি কেউ কেউ ইংরেজি জানেন না। ইংরেজি না জানা তাদের ভিন দেশ ভ্রমণে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন সব কাঙ্ক্ষিত দেশে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
ইংরেজি না জানা পর্যটকদের জন্য বহুভাষা রপ্ত করে নেন পর্যটকনির্ভর শপিংমল ও পর্যটন স্পটে কর্মরত কর্মী ও ব্যবসায়ীরা। যেমন কুয়ালালামপুরের চায়না টাউন ও বুকিত বিনতাং এলাকায় দোকানে কাজ করা বাংলাদেশি কর্মীরা মালয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি, আরবি, ফারসি, ইন্দোন, চাইনিজ, ইতালীয়, তামিলসহ পৃথিবীর নানা দেশের ভাষায় কম-বেশি কথা বলতে পারেন কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো। ক্রেতার সুবিধার জন্য ও ক্রেতার মন জয় করার জন্য তার ভাষায় কথা বলা বিক্রয়কর্মীর ভালো গুণগুলোর একটি। বাংলাদেশি প্রবাসীরা সেক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্য জাতির চেয়ে কিছুটা এগিয়ে বলবো।
জাপানের ইংরেজি না জানা মানুষদের সারল্য দেখলে বড় মায়া লাগে। আগাগোড়া সারল্যতায় ভরা জাপানি পর্যটকদের আচরণ। তাদের দেশে তারা কেমন জানি না। ভিন দেশের শহরে তারা খুব কোমলপ্রাণ। দৃশ্যমান দু’চোখের সাথে মনের চোখেই তারা সবকিছু বোঝার জানার চেষ্টা করেন। আসলে যে দেশের মানুষই হোক, ঘুরে বেড়ানোর সময় মনের চোখ খোলা রাখতে হয়। জগতের সব বিষ্ময় তো মনের মাঝেই গেঁথে যায়। ছায়া হয়ে রয়ে যায়। অটো-কম্পোজ হয়ে স্মৃতিগ্রন্থের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় অদৃশ্য অক্ষরে ভরে যায়।
বাঙালিরা একাধিক ভাষায় দক্ষতা অর্জনে দ্রুতগতির হলেও মাতৃভাষার প্রতি মায়া ও ভালোবাসায় জগতের অন্য জাতির চেয়ে কম নয়, বরং এগিয়ে; যার প্রমাণ দিয়েছেন আমাদের ভাই সালাম, রফিক, বরকত, শফিউর, জব্বারেরা তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে- সেই ১৯৫২ সালে। তাই তো ইংলিশদের দেশ যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে দীর্ঘকাল বসবাস করা সিলেটি বাঙালি ভাইটা কুয়ালালামপুরে এসে আরেক বাঙালি ভাইয়ের সাথে প্রাণখুলে বাংলায় কথা বলে ভাব বিনিময় করেন। ভাগ্যক্রমে কুয়ালালামপুরে বিক্রয়কর্মী ভাইটাও যদি সিলেটি হয়, তাহলে সরাসরি সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় কথার খই ফোটে। একই কথা চট্টগ্রামের মানুষদের বেলায়ও বলা যায়।
চট্টগ্রাম থেকে কুয়ালালামপুর শহরে বেড়াতে গিয়ে বুকিত বিনতাং এ হঠাৎ পরিচয় হওয়া চাটগাঁইয়া ভাইটাকে কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করেন চাটগাঁইয়া পর্যটক। তার সাথে জুড়িয়ে দেন চাটগাঁইয়া ভাষায় রাজ্যের কাহিনি; যা মাতৃভাষার প্রতি মানুষের স্বভাবজাতটান বলা যায়। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। আমাদের মাতৃভাষা ‘বাংলা’ আমাদের অহংকার, আমাদের ‘বাংলা বর্ণমালা’ আমাদের চিরকালের গর্ব।
সার কথা- ইংরেজি, স্প্যানিশ, আরবি, ফারসি, চাইনিজ বা একাধিক ভাষা শেখা মানে নিজস্ব দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়ানো। ইংরেজি বা ভিন দেশি ভাষা না জানলেও মনের জোর ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে মাতৃভাষা দিয়েই সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেওয়া যায়। ঘুরে দেখা যায় বিশ্ব। আহরণ করা যায় নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। ভারী করা যায় উপলব্ধির নির্যাস ভাণ্ডার। ঋদ্ধ করা যায় হৃদয়ের খেরোখাতা। লেখক :