সমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০২:২৬ pm
নিজস্ব প্রতিবেদক : উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে রোগ নির্ণয়ে উন্নত প্যাথলজি টেস্টের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতা ও জটিলতাসহ সুবিধাবাদি অসৎ গোষ্ঠীর অপতৎপরতায় সরকারি হাসপাতালে প্যাথলজি টেস্টের উন্নয়ন থমকে থাকে। সরকারের উচ্চ মূল্যে কেনা যন্ত্রপাতি বছরের পর বছর পড়ে থেকে নষ্ট হওয়ার চিত্রও প্রায়শই দেখা যায়।
তবে নানা প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে প্যাথলজি টেস্টের ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করতে কর্তৃপক্ষের নেয়া উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হাজারো রোগি। স্বল্প খরচে মিলছে মানসম্পন্ন ৪০ টির অধিক প্যাথলজি টেস্টের সুবিধা। একই সঙ্গে ইনডোর রোগীদের জন্য নেয়া প্যাথলজি টেস্টের সম্প্রসারিত আধুনিক পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। যেটাকে স্বাগত জানাচ্ছেন রোগীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্দিষ্ট সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে হাসপাতালে সকল প্যাথলজি টেস্টের ব্যবস্থা করা হলে রোগীরা লাভবান হবেন। আসাধু ডাক্তারদের কমিশনের বিনিময়ে রোগীদের অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দেয়ার মানসিকতার পরিবর্তন হবে।
অদক্ষকর্মীদের দিয়ে বিভ্রান্তিকর রির্পোট ও পরবর্তীতে রোগীর অপচিকিৎসা রোধ হবে। রোগীদের দুর্ভোগ কমবে। দালালদের দৌরাত্ম্য কমবে। রোগীরা দালালের খপ্পরে পরে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। সর্বোপরি হাসপাতালের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাবে। এরইমধ্যে বাস্তবায়িত উদ্যোগের সুফল রোগীরা পাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভাগীয় শহরে অবস্থিত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেকে কেন্দ্র করে আশেপাশে বিভিন্ন নামে-বেনামে পঞ্চাশের অধিক ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজি সেন্টার গড়ে উঠেছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের মালিক স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা থেকে শুরু করে হাসপাতালের অভ্যন্তরে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী।
এসব ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজি সেন্টারের অধিকাংশেরই মূল র্টাগেট থাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কমিশনের বিনিময়ে একাধিক দালাল গোষ্ঠীও পরিচালনা করে তারা। যাদের দৌরাত্ম্যে রোগীরা চিকিৎসা করাতে এসে একদিকে যেমন সর্বস্বাস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সুচিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানায়, এসব ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজি সেন্টারসহ প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অদৃশ্য স্বার্থের চাপে থাকতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। একারণে হাসপাতালের প্যাথলজি ব্যবস্থার উন্নয়ন পরিকল্পনা থমকে থাকে। তবে রোগীবান্ধব বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানীর নেতৃত্বে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেই অদৃশ্য শক্তির চাপ মোকাবিলা করেই করোনা মহামারিকালেও হাসপাতালের প্যাথলজি ব্যবস্থাকে উন্নত করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। যার সুফল এরইমধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গত ১০ মাসের প্যাথলজি টেস্টের রির্পোট বলছে, এই হাসপাতালের প্যাথলজি টেস্টের আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাভোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৪ হাজার ২৮০ জন রোগী ১৩ হাজার ৬৫১ টি টেস্ট হাসপাতাল থেকে করিয়েছেন।
যেটা অক্টোবর মাসে বেড়ে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮০৮ জন। এবং টেস্টের সংখ্যা ৩০ হাজার ২২২ টি। ৮ মাসের ব্যবধানে সুবিধাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৫২৮ জন। এবং টেস্টের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৫৭১ টি। এরমধ্যে ফেব্রুয়রি মাসে ৪ হাজার ৮৫০ জন রোগী ১৪ হাজার ৩১৩ টি প্যাথলজি টেস্ট, মার্চ মাসে ৫ হাজার ৩৯৭ জন রোগী ১৬ হাজার ৪২০ টি প্যাথলজি টেস্ট, এপ্রিল মাসে ৩ হাজার ৮৪৭ জন রোগী ১০ হাজার ৫৯৮ টি প্যাথলজি টেস্ট, মে মাসে ৩ হাজার ৬০৭ জন রোগী ১১ হাজার ৩৩২ টি প্যাথলজি টেস্ট, জুন মাসে ৩ হাজার ৮ জন রোগী ৯ হাজার ৫৪৬ টি প্যাথলজি টেস্ট, জুলাই মাসে ৩ হাজার ১৪৭ জন রোগী ১০ হাজার ৬৬ টি প্যাথলজি টেস্ট, আগস্ট মাসে ৭ হাজার ৯৯ জন রোগী ২৩ হাজার ৫৫০ টি প্যাথলজি টেস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে ৭ হাজার ৯৩৪ জন রোগী ২৭ হাজার ৫৫৪ টি প্যাথলজি টেস্ট হাসপাতাল থেকে করিয়েছেন। উত্তরোত্তোর এই সংখ্যাটি আরও বাড়বে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগীরা বলছেন, বর্তমানে চিকিৎসা খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এরমধ্যে ডাক্তাররাও আগের চেয়ে বেশি বেশি টেস্ট দেন। যেগুলো খুবই ব্যয়বহুল। সরকারি হাসপাতালে কম খরচে ভালো চিকিৎসার আশায় তারা এসেছেন। সেখানেও খুব একটা স্বস্তি ছিলো না।
তবে রাজশাহী মেডিকেলে গত এক-দু’বছরের মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবেশ উন্নত হয়েছে। বাইরে একটা টেস্ট করাতে যেখানে এক হাজার, দেড় হাজার টাকা দিতে হয়। সেখানে হাসপাতালে ২০০ থেকে আড়াইশ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলা থেকে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন আশরাফ আলী। তিনি জানান, তিনি দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান। দিন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থা। এরমধ্যেই ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তার একসঙ্গে ৩ টা প্যাথলজি টেস্ট দিয়েছেন।
যে টেস্টগুলো ডাক্তার কোথায় করাতে দিয়েছেন এটা না বুঝেই বাইরে করাতে চেয়েছিলেন। বাইরে এক দালালের সহযোগিতায় নিয়েছিলেন। সে ৮ হাজার টাকা চান। কিন্তু এতোটাকা তার কাছে ছিলো না। পরে ডাক্তার জানান, এই টেস্টগুলো হাসপাতালেই করা হয়। সেখানে দেড় হাজার টাকায় টেস্ট করেছেন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোর প্যাথলজি অ্যান্ড মোলিকুলার বায়োলজি ল্যাবের অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর অ্যান্ড হেড ডাক্তার মাহামুদা নাজনিন জানান, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের উন্নয়নে বর্তমান পরিচালক বেশকিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। গত আগস্ট মাসে নতুন করে কিছু যন্ত্রপাতি যোগ হয়েছে।
বর্তমানে হাসপাতালে সিবিসি, টোটাল প্লানেট কাউন্ট, সিপিবিএফ, টিসি, ডিসি, ইএসআর, এইচবি, বিটি, সিটি, র্যানডোম ব্লাড সুগার, এইচএস-সিআরপি, টিআরওপিওনিন, ফিইআরআরআইটিআইএন, ডি-ডিমারসহ ৪০ টির অধিক টেস্ট করা হচ্ছে। এতে সুবিধাভোগীদের সংখ্যাও বেড়েছে। সামনে আরও বাড়বে।
তিনি আরও জানান, হাসপাতালের এসব প্যাথলজি টেস্টের খরচ খুবই কম। বাইরের চেয়ে চার-পাঁচগুন কমে সরকারের নির্ধারিত মূল্যে টেস্ট করানো হয়।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, হাসপাতালের সকল রোগীর যে সব প্যাথলজি টেস্টের প্রয়োজন যেগুলোর ব্যবস্থাপনা হাসপাতালেই করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।
এরইমধ্যে পরিকল্পনার কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। নতুন মেশিনসহ জনবল যোগ হয়েছে। সরকারের নির্ধারিত চার্জের মাধ্যমেই রোগীরা সেবা পাবে। এখন নতুন করে তিনটি বিভাগে অস্থায়ী বুথ স্থাপনের কাজ চলছে। যেটি আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে শেষ হবে।
এই বুথের মাধ্যমে রোগীদের বেড থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করে বেডে রির্পোট পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। রোগীর ভোগান্তিহীন উন্নত সেবা নিশ্চিতের তাগিদেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর সুফল এরইমধ্যে রোগীরা পাচ্ছেন। আজকের তানোর