শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:০৩ pm
বিশেষ প্রতিবেদক : রাজশাহীতে একসময় কুলা থেকে শুরু করে বাড়িতে বসার মোড়া, খাট, সোফা সেট, বই রাখার সেলফসহ অধিকাংশ আসবাবপত্রই ছিল বেতের। দামে সস্তা ও নাগালের মধ্যে থাকায় বেশ কদরও ছিল বেতশিল্পের। তবে কালের বিবর্তনে বেতের তৈরি আসবাবপত্রের বদলে জায়গা দখলে নিয়েছে প্লাস্টিক, লোহা ও প্লেনসিটের আসবাব। এতে প্রায় হারাতে বসেছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী বেতশিল্প।
মহানগর ঘুরে দেখা মিলেছে ৯টি বেতের কারখানা ও ২টি শোরুম। এরমধ্যে কিছু ব্যবসায়ী জানান, এক সময় নগরীর হোসনীগঞ্জ বেতপট্টিতেই ছিল ১৪ থেকে ১৫টি বেতের দোকান। সেখানে বর্তমানে রয়েছে সিদ্দিক, ফরিদ ও আব্দুল কাদেরের একটি করে দোকান। ওই ৩টি দোকান বন্ধগেট এলাকা থেকে আসবাব নিয়ে হোসনীগঞ্জে বিক্রি করে। এছাড়া বাকি ৬টি দোকান রয়েছে মেডিকেল ক্যাম্পাস বন্ধগেটের দিকে। বর্তমানে বন্ধগেটেই রয়েছে বেতের আসবাবপত্র তৈরির কারখানারগুলো।
জানা গেছে, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারেও এক সময় কয়েদীদের দিয়ে বেতশিল্পের কাজ করানো হতো। তবে কালক্রমে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর বর্তমান জেলসুপার সুব্রত কুমার বালা বলেন, বর্তমানে বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র নির্মাণ হচ্ছে, বেতের নয়। একসময় এ শিল্পের কাজ কারগারেও হতো। তবে খুব শিগগিরই বেতশিল্প নিয়ে কারাগারে কাজ করানো হবে। এনিয়ে আলাপ-আলোচনা চলমান রয়েছে বলেও জানান এই কারা কর্তৃপক্ষ।
কালের বিবর্তনে বেশকিছু বেতের তৈরি আসবাবপত্রের বিলুপ্তি ঘটেছে। বিলুপ্ত আসবাবগুলোর মধ্যে রয়েছে ধান রাখার কাঠা, ঝুড়ি, ডালা, বেতের পাটি বা সপ, হাতপাখা, কুলা, চাঙ্গারী, চালোন, ধামা, পাতি ও বই রাখার তাক প্রভৃতি।
বর্তমানে রাজশাহীর বেতের দোকানগুলোতে তৈরি হচ্ছে- মোড়া, বই রাখার তাক, চেয়ার, টি-টেবিল, ডাইনিং টেবিল, সোফা সেট, বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় দোলনা, ছোট-বড় রকিং চেয়ার। রাজশাহীর বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট, অফিসের শৌখিন পার্টিশন, সরকারি রেস্ট হাউজ ও সৌখিন ধনাঢ্য পরিবারগুলো স্বল্প পরিসরে বেতের আসবাব ব্যবহার করেন। বর্তমানে রকিং চেয়ার, দোলনা, সোফাসেট ও টি-টেবিলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
হোসনীগঞ্জ বেতপট্টির ব্যবসায়ী আলমগীর বলেন, এক সময় হোসনীগঞ্জের বেতপট্টির দু’পাশ জুড়ে ১৪-১৫টি দোকান ছিল। কিন্তু বেতের তৈরি জিনিসের চাহিদা কমতে থাকায় অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এখন মাত্র তিনটি দোকান রয়েছে। চাহিদা না থাকায় বেতের পাশাপাশি বাঁশের তৈরি মালামাল বিক্রি করছেন তারা।
বন্ধগেটে আরিফ হোসেন নামের এক কারিগর জাগো নিউজকে বলেন, বাবার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই এই পেশায় কাজ করছি। বাবার সঙ্গে থেকে শিখেছি এই কাজ। এখন আমিও এই পেশার মানুষ। ২০ থেকে ২২ বছর কেটে গেলো বেতশিল্পের কারিগর হিসেবে কাজ করে।
বেতশিল্পের অতীত-বর্তমান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এক সময় প্রচুর বেচাকেনা হতো। এখন কাজের অবস্থা ভালো না। হাতেগোনা কিছু কাস্টোমার ছাড়া লোক পাওয়া যায় না। তবে বেতের অধিকাংশ কাস্টোমার বড়লোক ও অফিস-রেস্তোরাঁর মালিক হয়ে থাকেন।
বন্ধগেট এলাকার আরেক ব্যবসায়ী ফরিদুর রহমান জানান, আগে বনজঙ্গল বেশি ছিল। তাতে বেত চাষ হতো। ফলে দেশের নওগাঁ, দিনাজপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে বেত আনা হতো অল্প দামে। এখনও রাজশাহীতে সিলেট, চট্টগ্রাম ছাড়াও বিদেশ থেকে বেত কিনে কাজ করতে হয়। তাতে দাম কয়েকগুন বাড়লেও তেমন বাড়েনি বেতের তৈরি জিনিসের দাম।
তিনি আরো জানান, চাহিদা কমে যাওয়ায় এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কারিগররাও। সবমিলে বেত সঙ্কট, শ্রমিক সঙ্কট, বাজারে পণ্যের চাহিদা কম থাকায় ধুকছে এই শিল্পটি। এই শিল্পকে বাঁচানো এখন চ্যালেঞ্জ ছাড়া আর কিছু না। কারণ আমাদের বয়স হয়েছে। বিকল্প পেশায় যাওয়া সম্ভব নয়। আর এই পেশায় নতুন করেও কেউ আসছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সবচেয়ে বেশি বেত উৎপন্ন হয় ইন্দোনেশিয়ায়। ইন্দোনেশিয়ায় উৎপন্ন বেতের গুণগতমানও সবচেয়ে উন্নত। এছাড়া ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডেও বেত জন্মায়। তবে রাজশাহীতে মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে বেত আসে সবচেয়ে বেশি।
সূত্র মতে, মিয়ানমার থেকে আসা প্রতিটি বেতের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। যা ১০ থেকে ১২ ফুট লম্বা। এছাড়া দেশি বেত মোটাগুলোর মূল্য ১০০ টাকা ও ফালি বা পাতলা বেতের মূল্য ৩০ থেকে ৫০ টাকা। ভারত থেকে আসা বেতের মূল্য ১০০ থেকে ২০০ টাকা। ইন্দোনেশিয়ার বেতের মূল্য সবচেয়ে বেশি। ইন্দোনেশিয়ার একেকটি বেতের দাম পড়ে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। যা ১০ থেকে ১২ ফুট লম্বা হয়ে থাকে এবং ফালি বা পাতলা বেত ৭০০ টাকা করে কিনতে হয়।
বিচিত্রা দোকানের মালিক আহম্মেদ আলী উদ্দিন জানান, বর্তমানে ধরন ভেদে চেয়ার বিক্রি হয় প্রতিটি দুই থেকে সাত হাজার টাকায়। সোফাসেট বিক্রি হয় ১৪ থেকে শুরু করে ৭০ হাজারে, মোড়া ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা, ৬ সেটের ডাইনিং ১৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা। এছাড়া খাট ৫ থেকে ৭০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।
বেতশিল্পের তথ্য নিতে যাওয়া হয় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো কার্যালয়, রাজশাহী বিসিক কার্যালয় ও রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে। কিন্তু এগুলোর কোনো কার্যালয়েই মেলেনি বেতশিল্প সম্পর্কিত তথ্য। ফলে বেতের বাণিজ্যিক চাষ ও এর সম্প্রসারণের কোনো পদক্ষেপ না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই বেতশিল্প হারাচ্ছে তার ঐতিহ্য।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক জাফর বায়োজীদ বলেন, আমরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। ব্যবসায়ীরা তাদের সমস্যার কথাগুলো আমাদের জানালে আমরা সেইভাবে কাজ করবো। এছাড়া এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা মানুষগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করারও চেষ্টা করবো। কিন্তু এবিষয়ে কেউ কোনো যোগাযোগ করে না। আজকের তানোর