রবিবর, ১০ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০২:২৩ pm
মুম্বই হামলার মূলহোতারা লাহোর হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে আবারও প্রমাণ হলো, পাকিস্তান জঙ্গিদের এখনও মদদ জুগিয়েই যাচ্ছে। আদালতে মুম্বাই হামলায় অভিযুক্ত ছয় জঙ্গির বিরুদ্ধে শক্ত কোন তথ্য-প্রমাণ হাজির করেনি পাকিস্তানি কর্মকর্তারা।ফলে আলোচিত ঐ হামলার মাস্টারমাইন্ড হাফিজ সইদের নিষিদ্ধ সংগঠন জামাত-উদ-দাওয়ার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। আর লাহোর হাইকোর্টও তাদের বেকসুর খালাস দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মহলকে বোকা বানিয়ে পাকিস্তান আবারও জঙ্গিদের পক্ষেই অবস্থান নিলো। এর ফলে স্পষ্ট হলো, সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তান বা তাদের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মনোভাব বিন্দুমাত্র বদলায়নি। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর ছত্রছায়ায় জঙ্গিরা গোটা দুনিয়াতেই জিহাদের নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান এখনও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের আঁতুর ঘর। আর ইসলামাবাদ তাদের এমন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেটা বারবার গোটা দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছে ।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইতে আইএসআইয়ের মদদপুষ্ট জঙ্গিরা এক ভয়াবহ হামলা চালায়। তাজমহল হোটেলের অতিথিরাই ছিলেন সেদিনের আক্রমণের মূল লক্ষ্য। জঙ্গি হামলায় ৬ আমেরিকানসহ ১৬টি দেশের মোট ১৬৬ জন নিহত হয়েছিলেন। গুরুতর আহত হয়েছিলেন আরও অন্তত ৭টি দেশের নাগরিকরা। নিহত বা আহতদের একটা বড় অংশই ছিল পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষ। ইজরায়েল, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্সসহ আরও বেশকিছু দেশের একাধিক নাগরিক মুম্বাই হামলার নিহত হন। বিবিসি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, পশ্চিমা পর্যটকরা ওই হামলার অন্যতম টার্গেট ছিলেন।
গোটা দুনিয়ার সবাই জানে , হাফিজ সঈদের নেতৃত্বাধীন লস্কর-ই-তৈয়াবাই মুম্বাইয়ের হোটেল তাজে হামলা চালায়। পুরো হামলার মূল মাথা ছিলেন হাফিজ নিজে। তিনিই গড়ে তুলিছেলেন লস্করের ‘ছায়া’ সংগঠন জামাত-উদ-দাওয়া। আর সেই জামাত-উদ-দাওয়ার শীর্ষ ৬ নেতাকে লাহোরের সন্ত্রাসবিরোধী একটি আদালত ২০২১-এর এপ্রিলে ৯ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। ট্রায়াল কোর্ট সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছিল তাদের। অভিযুক্তদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।
সেই সাজাপ্রাপ্তরা হলেন, অধ্যাপক মালিক জাফর ইকবাল, ইয়াহিয়া মুজাহিদ, নাসারুল্লাহ, সামিউল্লাহ এবং উমর বাহাদুর। এছাড়াও পাঞ্জাব পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ডিপার্টমেন্টের একটি এফআইআরের ভিত্তিতে হাফিজ সঈদের শ্যালক হাফিজ আবদুল রহমান মাক্কিকেও ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত।
তবে লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ আমির ভাট্টি ও বিচারপতি তারিক সেলিম শেখের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ ট্রায়াল কোর্টের রায় খারিজ করে দিয়েছেন। তথ্য প্রমাণের অভাবে উচ্চ আদালত ৬ কট্টর জঙ্গি নেতাকেই বেকসুর খালাস করে দিলেন।
আদালতের চাওয়ার চেয়েও ইমরান খানের সরকার জঙ্গিদের মুক্তি বেশি চাইছিলো। তাই আদালতকে কোনও সাহায্যই করা হয়নি। এমনকি, ১৬৬ জনকে হত্যা করার মতো ভয়ঙ্কর হামলার ষড়যন্ত্রীদের মাত্র ৯ বছরের সাজাটুকুও যাতে খাটতে না হয় সেই চেষ্টাতেই ব্যস্ত ছিল সেনাববাহিনীর হাতের পুতুল ইমরান সরকার।
ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়, মামলাটাই এমন ভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে করে হাফিজ সঈদ বা তার দলের অন্যরা বিন্দুমাত্র বিপদে না পড়েন। ২০০৮ সালের মুম্বই হামলায় লস্কর যুক্ত থাকার সমস্ত প্রমাণ পেয়েও বিস্ববাসীর কাছে তা গোপন রাখার চেষ্টা করে পাকিস্তান। পুরো বিচার ব্যবস্থাটাকেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সামনে প্রহসনে পরিণত করেছে এই সন্ত্রাসবাদি দেশটি।
তবে মুম্বই হামলার পর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকায় পাকিস্তান ৭ জনকে ‘লোক দেখানো’ গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু হামলার অন্যতম হোতা জাকিউর রহমান লাখভীকে ২০১৫ সালেই জামিনে মুক্তি দেয়। মুম্বাই হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ভারত সমস্ত রকম প্রমাণ পাকিস্তানের হাতে তুলে দিলেও শক্তভাবে এই সন্ত্রাসীদের দমনে কোন তাগিদই দেখায়নি দেশটি। শুধু ভারতই নয়, জঙ্গিবাদের অর্থায়নকারীদের উপর নজর রাখা আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)-ও জঙ্গিদের অর্থায়নে পাকিস্তানের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে।
চার দশক ধরে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদকে মদদ জুগিয়ে চলেছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি। শুধু মুম্বই হামলাই নয়, আমেরিকায় ৯/১১ হামলার ষড়যন্ত্রেরও আঁতুর ঘর ধরা হয় পাকিস্তানকে। ২০০৫ সালে লন্ডন বিস্ফোরণে ৫৬ জনের মৃত্যু, ২০১৯ সালের লন্ডন ব্রিজে হামলা, ২০১৬ সালে উরিতে আক্রমণের ষড়যন্ত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে পাকিস্তানের মাটি।
বহুকাল ধরে জিহাদের নামে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনকে মদদ জুগিয়ে চলেছে দেশটির সেনাবাহিনী। কিন্তু সবকিছু জেনেও পশ্চিমা দুনিয়া পরমানুশক্তিধর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বরং যুক্তরাষ্ট্র থেকে এতো কিছুর পরেও পাকিস্তান ২০০২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য পেয়েছে। অথচ, ওসামা বিন লাদেন, খালিদ শেখ মোহাম্মদ, রামজি বিন আল-শিব, আবু জুবায়দাহ, আবু লাইথ আল লিবি এবং শেখ সাইদ মাসরির কট্টর জঙ্গিবাদীরা পাকিস্তানেই আশ্রয় নিয়েছিল।
সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পাকিস্তানের দ্বিমুখিতা গোটা দুনিয়াই জানে। ২০১০ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন জঙ্গিবাদে মদদের প্রশ্নে প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সতর্কও করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অফ রিপ্রেজেনটেটিভস-এও সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পেশ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সন্ত্রাসের প্রশ্নে পাকিস্তানের ‘মিথ্যা ও প্রতারণা’র কড়া সমালোচনা করেছিন এক সময়। তালেবান ও আল-কায়দার সঙ্গে পাকিস্তানি যোগসাজসের বিষয়টি গোটা দুনিয়ার সামনেই উন্মুক্ত। তবু আজও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে মদদ জুগিয়ে চলেছে সেনা নিয়ন্ত্রিত ইমরান খান সরকার। পারভেজ মুশারফের সময় থেকেই পাকিস্তানি সেনারা দেশের জন্য কাজ করার পরিবর্তে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণে বেশি ব্যস্ত।
আর তাদের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদকে টিকিরে রাখার জন্য স্ররবদা সচেষ্ট ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রযুক্তিগত ভাবে তালেবান ও অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি চীন থেকেও ইদানিংকালে সাহায্য পাচ্ছে। মুম্বই হামলার সঙ্গে যুক্তদেরই শুধু নয়, গত বছর ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের আদালত আল-কায়দার অন্যতম নেতা ও সন্ত্রাসী আহমেদ ওমর সঈদ শেখ ও তার তিন সহযোগীকে মুক্তি দিয়েছে। মার্কিন সাংবাদিক ডানিয়েল পার্ল হত্যার অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে।
মোদ্দাকথা, পাকিস্তান জঙ্গিবাদকে মদদ দেয়াকেই তাদের রাষ্ট্রীয় ধর্ম বলে মনে করে। তাই যুক্তরাষ্ট্র যাই বলুক না কেন, সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গ দেয়া তারা কিছুতেই বন্ধ করবে না।। তাই ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র হাফিজ সঈদের মাথার দাম ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘোষণা করলেও পাকিস্তানে অবাধে ঘুরে বেড়াতে পেরেছিল এই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী। আর তাই পাকিস্তান আজও জঙ্গিবাদের আঁতুর ঘরই হয়ে রয়েছে। বিন্দুমাত্র সন্ত্রাস দমনে আগ্রহী নয়। মাঝেমধ্যে চাপে পড়ে বেসুরো গাইলেও আসলে জঙ্গিবাদই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রধর্ম। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।