শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৬:০০ am
সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি বলেছেন, জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি চূড়ান্ত বিচারে আমাদের কখনো ভালো কিছু দিতে পারবে না। এটি ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত। এতে জনগণের মধ্যে যে আস্থাহীনতা ভর করেছে, তা দিনে দিনে আরও বাড়বে। বিনিময়ে আমাদের শুধু অন্ধকার সিঁড়ি পাড়ি দিতে হবে। যেখানে এক সময় টানেলের শেষপ্রান্তের আলোর দেখাও মিলবে না।
তিনি আরও বলেন, এর ফলে রাজনীতিবিদরা কখনো বিপদে পড়লে সাধারণ মানুষ পাশে থাকবে না। কর্মচারীরা শাসকের ভূমিকায় চলে আসবে। তাই আমি মনে করি, সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। সর্বত্র চেইন অব কমান্ড ঠিক রেখে সাধারণ জনগণকে বেশি করে ভালোবাসতে হবে। যিনি জনগণের প্রকৃত ভালোবাসা বুকে ধারণ করতে পারবেন, তিনিই হবেন প্রকৃত সফল এবং সার্থক রাজনীতিবিদ। আল্লাহর রহমতে সব ষড়যন্ত্র তার জন্য সাময়িক, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণে সব বিপদ তিনি উতরে যাবেন এক সময়।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি তার বক্তৃতায় অর্থ পাচার রোধ, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারের আর্থিক প্রণোদনা সমভাবে বণ্টন, করোনা মহামারি রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণসহ নানা বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
অর্থ পাচার ও ঋণখেলাপির প্রসঙ্গ তুলে ধরে সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, অর্থ পাচার ও ঋণখেলাপির ঘেরাটোপ থেকে আমরা এখনো বের হতে পারিনি। সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে এ দুটি ঘৃণিত বিষয় নিয়ে প্রতিদিনই খবর আসছে।
আলোচনার শুরুতেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতেই হবে। না হলে একজন বাঙালি, বাংলাদেশি হিসেবে বড় অকৃতজ্ঞ হয়ে থাকতে হবে। একই সঙ্গে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি- তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। নানামুখী ষড়যন্ত্রের মধ্যেও যিনি স্বমহিমায় এখনো অবিচল। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা করে যাচ্ছেন। বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি তাদের প্রতি- দেশ-মাতৃকার টানে যারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে দিয়ে গেছেন প্রাণ। ভাষার মাসও আসন্ন। তাই সেই সব ভাষা শহীদদের প্রতিও আমার সশ্রদ্ধ স্যালুট।
তিনি বলেন, রুহের মাগফিরাত কামনা করছি আমাদের জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিদেহী আত্মার প্রতি। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তার হাজারও কীর্তি। তাই তার পরকালীন জীবনের শান্তি কামনা করছি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে।
জাতীয় পার্টির এই নেত্রী বলেন, এক সময় যারা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে স্বৈরাচার বলে আখ্যা দিয়েছিল, তারা বহু আগেই তাকে ছাড়িয়ে গেছে অবিশ্বাস্য সব মাত্রায়। তিনি বলেন, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি- জাতীয় পার্টির সুযোগ্য চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের প্রতি। যিনি সম্প্রতি করোনামুক্ত হয়েছেন। আমরা তার সুস্থতা কামনা করছি। ইনশাআল্লাহ, তিনি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। এ সময় তিনি সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চিফ প্যাট্রন বেগম রওশন এরশাদের প্রতিও ধন্যবাদ জানান।
জাতীয় পার্টির এই নেত্রী বলেন, সবশেষে একটি কথা না বললেই নয়। তা হলো- করোনা মহামারির মধ্যে সরকারের প্রণোদনা কর্মসূচি। আমি বলতে চাচ্ছি, বিশ্বজুড়ে করোনা আঘাত হানার কারণে রফতানি মোটেই স্বাভাবিক হয়নি। দেশের যেসব স্বনামধন্য শিল্প গ্রুপ নতুন নতুন যেসব বৃহৎ শিল্প চালু করার দ্বারপ্রান্তে ছিল, সেগুলো তো চালু করা সম্ভবই হয়নি; বরং শতভাগ রফতানিমুখী চালু শিল্পগুলো টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর ফলে ঢালাওভাবে কোনো সুবিধা না দিয়ে যেসব শিল্প গ্রুপের অতীত রেকর্ড প্রশ্নাতীত, তাদের ব্যাপারে সরকারের বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি। সংসদ সদস্য হওয়ার পাশাপাশি যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় অর্থমন্ত্রী ও মাননীয় শিল্পমন্ত্রীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। নিশ্চয়ই এ বিষয়ে তারা সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, আমি মনে করি, মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণের মধ্যে যেসব ভালো ভালো কথা রয়েছে সেগুলো যদি আমরা সত্যিকারার্থে বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে এর বিভেদ-বৈরিতা আর থাকবে না। গণতন্ত্র সত্যিই সুসংহত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সব প্রত্যাশা তো পূরণ হওয়ার নয়। তাই এখন আর কোনো কিছুতে আক্ষেপ চলে না। সব যেন গা-সহা হয়ে গেছে। হতাশা ও আক্ষেপ শব্দ অভিধান থেকে মুছে যাবার উপক্রম হয়েছে। তবে জীবন ও স্বপ্ন তো থেমে থাকে না। তাই নানান প্রত্যাশা মানুষকে তার গন্তব্য পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখে।
তিনি বলেন, গত দুইদিন ধরে ভাবছিলাম- মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে কী বলব। সাধারণ মানুষ কী শুনতে চায়, কী জানতে চায়। চিন্তা করে দেখলাম, এবারের বিষয় হওয়া উচিত- ‘রাজনীতিবিদদের নিয়ে সাধারণ মানুষের ভাবনা কী।’ চট করে উত্তরটাও পেয়ে গেলাম। সাধারণ মানুষ এখন আর আমাদের নিয়ে ভাবে না। বেশিরভাগ রাজনীতিবিদকে তারা বিশ্বাসই করে না।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, আমি মনে করি, এটিই আমাদের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ। সাধারণ মানুষ ও ভোটাররা যদি আমাদের বিশ্বাসই না করে তাহলে এই রাজনীতি, এই কথিত আত্মত্যাগ কাদের জন্য? অথচ ইতিহাসের পাতায় প্রয়াত বহু রাজনীতিবিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। যাদের আদর্শ ধারণ করে এখনো অনেকে রাজনীতি করেন এবং রাজনীতিতে আসেন। যেসব নেতাকে একনজর দেখার জন্য মানুষ স্বেচ্ছায় পঙ্গপালের মতো ছুটে আসত। তাদের বক্তব্য ভাষণ শুনতে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। তারা একেকজন ছিলেন সেই পৌরাণিক গল্পের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। কিন্তু সেই সব মহান নেতার উত্তরসূরি হিসেবে সেই মানের রাজনীতিবিদ কী এখন আছে? থাকলে তার সংখ্যা কত হবে? জনমনে এটিই হয়তো এখন বড় প্রশ্ন।
তিনি বলেন, আমি রাজনীতিতে বেশি দিন আসিনি। কিন্তু যৎসামান্য এই পথচলায় কিছু তো শিখেছি। এখনো শিখছি, দেখছি, ভাবছি। কিন্তু কিছু কর্মকাণ্ড দেখে শুনে কখনো লজ্জিত হই, বিব্রতবোধ করি। তবে মান্যবর গুরুজনদের কাছ থেকে যেটুকু শিখেছি তাতে রাজনীতি মানেই প্রথম কথা হলো আত্মত্যাগ। নিঃস্বার্থ জনসেবা। মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। যেমনটি করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ। যাদের নামের সঙ্গে কোনো বিশেষণ যুক্ত করতে হয় না। তারা প্রত্যেকে একেকটি প্রতিষ্ঠান, আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। তাদের নাম শুনলেই মানুষ মনের গভীর থেকে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করে।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এ সময় প্রশ্ন রেখে বলেন, কিন্তু আজ কী হলো। কোথায় সেই রাজনীতি? এখন তো এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, প্রকৃত ত্যাগী এবং নীতিবান রাজনীতিবিদের কোনো মূল্যায়ন হয় না। বরং সর্বত্র হাইব্রিডদের জয়জয়কার। শর্টকাট পথে রাতারাতি ধনী হতে অনেকে রাজনীতিতে নাম লেখান। এটি নাকি ধনী হওয়ার বড় উপায় (!) একটি দলে যার নিজের এবং পরিবারের অতীত কোনো অবদান নেই, তিনিও বিশেষ সংযোগে হঠাৎ বড় নেতা হয়ে যাচ্ছেন। পদ পাচ্ছেন। এমনকি কেউ কেউ মহান সংসদেও ঢুকে পড়ছেন। কী দুর্ভাগ্য জাতির। তাই সাধারণ মানুষ মনে করে, রাজনীতি এখন একটা ব্যবসা। বাস্তবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ব্যবসা করার চেয়ে এখানে যোগ দিয়ে খুব দ্রুত ধনী হওয়া যায়। এ রকম একটি পারসেপশন সমাজে এখন তীব্রভাবে প্রতিষ্ঠিত।
তিনি বলেন, আমাদের সম্মিলিতভাবে জনমনে বদ্ধমূল থাকা নেতিবাচক এই পারসেপশন দূর করতেই হবে। এটি সময়ের দাবি। আমরা যারা এখানে আছি, তাদের অনেকে ষাটোর্ধ্ব। কে ক’দিন বাঁচব- কেউ জানি না। কিন্তু আমরা কি রেখে যাচ্ছি- পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তারা আমাদের জীবনালেখ্য নিয়ে কি গর্ববোধ করতে পারবে? যদি না পারে (!) তাহলে এ জীবন আমাদের বৃথা হয়ে যাবে। তাই রাজনীতির এই অন্ধগলি থেকে যতদিন আমরা মুক্ত হতে না পারব, ততদিন গণতন্ত্রও ওই অর্থে সুসংহত হবে না। দেশে সরকার থাকবে, দেশ উন্নতও হবে। ১৮ কোটি জনগণের ৩৬ কোটি হাত বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ করেই যাবে। আমাদের অহংকারের প্রতীক প্রবাসী ভাইবোনেরাও রেমিটেন্স পাঠাতে থাকবে। আমাদের রিজার্ভ বাড়তেই থাকবে। বাড়বে জিডিপি। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক মূল্যবোধের রাষ্ট্রে আমাদের অবস্থান কোথায় থাকবে? এটি অবশ্যই আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। তা না হলে রাজনীতিকে এক সময় ‘জাদুঘরে’ পাঠাতে হবে।
জাতীয় পার্টির এই কো-চেয়ারম্যান আরও বলেন, দরজায় কড়া নাড়ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আর মাত্র দুটি মাস। তারপর ২৬ মার্চ। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দেশের প্রতিটি মানুষের বহুল প্রত্যাশিত একটি ঐতিহাসিক দিন। চলছে মুজিববর্ষ। তবে প্রায় এক বছর যাবত বিশ্বজুড়ে আমদের সঙ্গী হয়ে আছে করোনার মতো এক মহামারি। এর মধ্যে বহু মানুষের প্রাণ গেছে এই করোনায়। হয়েছে অকাল মৃত্যু। না ফেরার দেশে চলে গেছেন আমাদের প্রিয় অনেক সতীর্থ, খ্যাতিমান ব্যক্তি। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে এই দোয়াই করছি সব সময়- তাদের মৃত্যুকে যেন আল্লাহ শাহাদাতের মৃত্যু হিসেবে কবুল করেন।সূত্র : যুগান্তর। আজকের তানোর