শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৮:১৫ am
ডেস্ক রির্পোট : ‘হামি আস্তার (রাস্তা) ধারত চা বিক্রি করি। চায়ের দোকান ছাড়া সহায়-সম্পত্তি বলতে আর কিছু নাই। আস্তার ধারেই সরকারি জায়গাত বেড়া-টিন দিয়ে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে থাকি। ছেলের চাকরির জন্য ১০ হাজার টাকা ঘুস দেওয়ার ক্ষমতাও নাই। স্বপ্নেও ভাবি নাই ঘুস ছাড়া হামার ছেলের পুলিশে চাকরি হবে। ছেলের চাকরি হওয়ায় এত খুশি হয়েছি যে, মুখে বলে বোঝাতে পারব না।’
পুলিশে চাকরি পাওয়া সাজ্জাদ বিন রিফাতের বাবা মজিদুর রহমান এসব কথা বলেন। সাজ্জাদ বিন রিফাতের বাড়ি নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলা সদরে। তার বাবা মজিদুর রহমান নজিপুর পৌরসভায় ফুটপাতের একজন চা বিক্রেতা।
সাজ্জাদের মতো খুশির বন্যা বইছে পুলিশে চাকরি পাওয়া পান বিক্রেতা রাকিবুল হাসানের পরিবারেও। রাকিবুলের বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার পরানপুর ইউনিয়নের চকমনোহর গ্রামে। তার বাবা ওহিদুর রহমান এলাকার বিভিন্ন হাটে হাটে ঘুরে পান বিক্রি করেন।
রাকিবুল হাসান বলেন, যখন আব্বাকে বললাম পুলিশে চাকরির জন্য আবেদন করব। তখন আব্বা বলেছিল, পুলিশে চাকরি পেতে ৮-১০ লাখ টাকা লাগে। পান বিক্রির আয় দিয়ে সংসার চলে না। কীভাবে হামি তোক এত টাকা দিমু। তুই পানওয়ালার ছইল, তুই কি পুলিশ হতে পারবু। আব্বার এসব কথার পরেও মনে আশা নিয়ে, ১০০ টাকায় ব্যাংক ড্রাফট করে পুলিশে চাকরির জন্য আবেদন করি। প্রথমে সাতটি ধাপে শারীরিক ফিটনেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এর পরে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাতেও পুলিশে চাকরির জন্য চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হই। এজন্য আমি আমার বাবা-মা ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ।
পুলিশ কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ ও অপেক্ষমাণ তালিকায় তালিকায় থাকা প্রার্থীদের শনিবার ডাকা হয় নওগাঁ পুলিশ লাইনস মাঠের ড্রিলস শেড মিলনায়তনে। ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন্য তাদের ডাকা হয়। সেখানে আসা অনেক চাকরি প্রার্থী ও অভিভাবকদের দাবি, এবার ঘুষ ছাড়াই চাকরি হচ্ছে।
নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী গ্রাম থেকে এসেছিলেন রেজাউল হক। তিনি একজন রিকশাচালক। তার মেয়ে লাবনী আক্তার কনস্টেবল পদে উত্তীর্ণ হয়েছেন। সকালে মেয়েকে পুলিশ লাইনস মাঠের ড্রিলস শেড মিলনায়তনে ঢুকে দিয়ে রিকশা নিয়ে পুলিশ লাইনসের প্রধান গেটের সামনে অপেক্ষা করছিলেন রেজাউল হক।
তিনি বলেন, টাকা দিয়ে মেয়েকে চাকরি দেওয়ার কোনো ক্ষমতা হামার নাই। স্ত্রী ও তিন মেয়ে লিয়ে হামার সংসার। রিকশার চাকা ঘুরায়ে কোনো মতন স্ত্রী-সন্তানের মুখত খাবার জোগান দেই। সেখানে মেয়ের চাকরির জন্য কোথা থেকে টাকা দিমু। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে নিজ যোগ্যতায় হামার মেয়েটা চাকরি পাইছে।
আত্রাই উপজেলার হাটকালুপাড়া ইউনিয়নের নন্দনালী গ্রামের বাসিন্দা কাঠমিস্ত্রি দিপক কুমার সূত্রধরের মেয়ে আশা রানী নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি বলেন, মেয়ে একদিন হামাক বলল, পুলিশে চাকরির জন্য আবেদন করবে। হামি ওক (তাকে) কই, পুলিশের চাকরিত ম্যালা টাকা ঘুস লাগে। সেই টাকা কুটি থ্যাকে তুক দিমু। মেয়ে কয়, এবার নাকি ঘুস ছাড়াই চাকরি হবে। হামার আপত্তি সত্ত্বেও এক-দেড়শ’ টাকা খরচ করে আবেদন করলু। এখন কোনো টাকা ছাড়াই, নিজের যোগ্যতায় হামার মেয়ে চাকরি পাইতে যাচ্ছে। নিয়োগ স্বচ্ছ হচ্ছে বলেই, হামার মেয়ের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।
নওগাঁ পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নওগাঁয় ৫৪টি পুলিশ কনস্টেবল পদের জন্য ৯ হাজারের অধিক প্রার্থী অনলাইনে আবেদন করেছিলেন। আবেদনকারী এসব প্রার্থীর মধ্যে ২ হাজার ১৬০ জনকে শারীরিক সহনশীলতা পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। এদের মধ্যে ১ হাজার ৮৪০ জন পুরুষ ও ৩২০ জন নারী।
শারীরিক সহনশীলতা পরীক্ষার জন্য প্রার্থীরা ২০০ ও ১৬০০ মিটারের দৌড়, পুশ আপ, লং জাম্প, হাই জাম্প, ড্র্যাগিং ও রোপ ক্লাইমিং ইভেন্টে অংশ নেন। শারীরিক সহনশীলতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৫২৮ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় দেয়।
লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১০৪ জন প্রার্থী গত বৃহস্পতিবার মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। ওই দিন সন্ধ্যায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ ৫৪ জন ও অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা ৮ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। এদের মধ্যে কেউ ডাক্তারি পরীক্ষায় মাদক গ্রহণের প্রমাণ কিংবা বড় ধরনের শারীরিক জটিলতা ধরা পড়লে তাদের কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে না।
নওগাঁর পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান মিয়া বলেন, যুগোপযোগী পুলিশ করার জন্য আইজিপি পুলিশ নিয়োগ পরীক্ষায় আধুনিকায়ন করেছেন। এমন একটি যুগান্তকারী পদ্ধতিতে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে, এখানে চাইলেও অনিয়ম করার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, নওগাঁয় নিয়োগ পরীক্ষা শুরুর আগে আমি কমিটমেন্ট করেছিলাম, নিয়োগ প্রক্রিয়া শতভাগ স্বচ্ছ হবে। আমার বিশ্বাস, আমার কমিটমেন্টের এক চুলও ব্যত্যয় হয়নি। শতভাগ স্বচ্ছ পরীক্ষায় নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে বলেই রিকশাওয়ালা, কাঠমিস্ত্রি, পান বিক্রেতা, দিনমজুর ও বর্গাচাষির ছেলে-মেয়েরা নিয়োগের জন্য উত্তীর্ণ হয়েছেন। এদের অনেকের ৪০-৫০ হাজার টাকা ঘুস দেওয়ার সক্ষমতাও নেই। কেবল যোগ্য প্রার্থী হিসেবেই তারা নিয়োগ পেয়েছেন। আজকের তানোর