শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৮:২১ am
ডেস্ক রির্পোট : সার সংকটে ভুগছেন দেশের অধিকাংশ জেলার কৃষকরা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে সারের কোনো সংকট নেই। গুদামে পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুদ আছে। সারাদেশে ডিলারদের কাছেও সার আছে। তবুও কৃষকরা সার পাচ্ছেন না। তাদের অভিযোগ, ডিলাররা গুদামে সার রেখে বলছেন নেই। আবার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দিলে তাদের কাছ থেকেই প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার পাওয়া যাচ্ছে।
রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। শীতকালীন সবজি, ভুট্টা ও বোরো আবাদের এ সময়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এর ফলে এ বছর উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষিবিদরা।
রবিশস্যের বীজ বপনের সময়কাল ১৬ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ে মূলত অ-ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। চারা গজানোর পর ব্যবহার করা হয় ইউরিয়া সার। অ-ইউরিয়া সারগুলোর একটি হচ্ছে টিএসপি।
কৃষিসংশ্নিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এদেশের কৃষকেরা তিউনিসিয়ার কালো টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) সার বেশি পছন্দ করেন। মাঠপর্যায়ে টিএসপি সার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হলেও তাতে এখনও সেভাবে সাড়া মেলেনি। সরকার কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি দিয়ে এই সার আমদানি করছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা কৌশলে বেশি দাম হাতিয়ে নিচ্ছেন।
সারের কৃত্রিম সংকট, দাম বেশি: কৃষকেরা যেন সহজে হাতের নাগালে সঠিক দামে সার কিনতে পারেন, এজন্য সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে সারের ডিলার নিয়োগ করে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়ে তারা সার বিক্রি করছেন না। বিক্রি করছেন শহরে। এতে সার পেতে কৃষকদের ভোগান্তিসহ অতিরিক্ত অর্থ ও সময় ব্যয় হচ্ছে।
কৃষক পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্য প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) টিএসপি ১ হাজার ১০০ টাকা (প্রতি কেজি ২২ টাকা), এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) ৭৫০ টাকা (১৫ টাকা কেজি) এবং ডিএপি (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট) ৮০০ টাকা (১৬ টাকা কেজি)। কৃষকরা বলছেন, প্রকারভেদে বস্তায় এবার তাদের সারের জন্য ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার কৃষকদের অভিযোগ, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের জন্য ১০ জন সার ডিলার নিয়োগ দেওয়া হলেও কেউই ইউনিয়নে গিয়ে সার বিক্রি করছেন না। সবাই বদরগঞ্জ পৌর শহরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে সার বিক্রি করছেন। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সার নিতে পৌরসভায় আসতে হচ্ছে কৃষকদের। পাশাপাশি প্রতি বস্তায় সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে।
রাজশাহীতে ইউরিয়া, টিএসপি, পটাশসহ সব ধরনের সারের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার কৃষক আবু তাহের বলেন, সারের দাম বেশি নেওয়া হলেও ডিলাররা পাকা রসিদ (ভাউচার) দিচ্ছেন না। প্রমাণসহ অভিযোগও দেওয়া যাচ্ছে না।
লালমনিরহাটের পাটগ্রামের কৃষক সোহেল রানা বলেন, এখনও পুরোদমে ভুট্টার চাষ শুরু হয়নি, তাতেই বেশি দাম ছাড়া সার পাওয়া যাচ্ছে না।
কুড়িগ্রামের রৌমারীতে সারের দাম বেশি রাখার বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী কৃষকরা। তাদের অভিযোগ, কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা নিয়মিত সারের বাজার মনিটর না করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
মানিকগঞ্জের শিবালয়ের কৃষক মো. আলমাছ মিয়া বলেন, সারের জন্য ডিলারদের দোকানে দোকানে ঘুরেও গত তিন দিনে সার নিতে পারিনি। দাম বেশি না দিলে সার পাওয়া যায় না।
সার বেচাকেনায় অনিয়ম প্রসঙ্গে শিবালয়ের সাব-ডিলার নিজাম উদ্দিন বলেন, টিএসপি সার সংকট হওয়ায় বাড়তি টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। তাই বাধ্য হয়ে দাম বেশি নিতে হচ্ছে। এক বস্তা টিএসপি সার বিক্রি করছি ১৩৫০ টাকা।
সরকার নির্ধারিত দাম ১১০০ টাকা, আপনি কেন বেশি নিচ্ছেন- এমন প্রশ্নে নিজাম উদ্দিন বলেন, ডিও’র মালপত্র না থাকায় আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে বেশি টাকা দিয়ে টিএসপি সার আনছি। এ কারণেই দাম বেশি নিতে হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ শাখার অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুবুল ইসলাম বলেন, যেসব জায়গা থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেই উপজেলাগুলোর কৃষি কর্মকর্তাদের বাজার পরিদর্শন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বেশি দামে সার বিক্রির তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেও আছে। তবে এ বিষয়ে তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গত ২৬ অক্টোবর সব জেলা প্রশাসক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে একটি চিঠি পাঠায় সার ব্যবস্থাপনা শাখা। চিঠিতে বলা হয়, ডিলারদের নামে বরাদ্দকৃত সার আইনগত হস্তান্তরযোগ্য নয়। কিন্তু ডিলাররা সারের ডেলিভারি অর্ডার অনেক ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী অথবা পরিবহন ঠিকাদারদের কাছে বিক্রয় করে দেওয়া এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা নির্ধারিত স্থানের সার অনির্ধারিত স্থানে বেশি দামে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ আসছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডিলাররা সার উত্তোলন না করে বস্তাপ্রতি টাকার বিনিময়ে ডেলিভারি অর্ডার বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
এ অবস্থায় কঠোর নজরদারির নির্দেশনা দেওয়া হয় চিঠিতে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, দেশের ১৭ জেলায় বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) গুদামে এক লাখ ১১ হাজার ৮৮৬ টন সার মজুদ আছে। কোনো সংকট হবে না।
এ ব্যাপারে সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখার উপ-প্রধান বদিউল আলমের ভাষ্য, সারাদেশে সাড়ে ৫ হাজার সারের ডিলার রয়েছে। এ মুহূর্তে আমদানিকারক ও সরকারের দুটি সংস্থার কাছে আট লাখ টন ইউরিয়া, আড়াই লাখ টন টিএসপি, সাত লাখ টন ডিএপি মজুদ আছে। সারের কোনো সংকট নেই।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে আটটি সার কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি ইউরিয়া কারখানা। একটি টিএসপি সার কারখানা এবং একটি ডিএপি কমপ্লেক্স।
ইউরিয়া সার কারখানাগুলোর মধ্যে পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড (পিইউএফএফএল) ও ঘোড়াশালে অবস্থিত ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড (ইউএফএফএল) আধুনিকীকরণের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ রয়েছে।
সূত্র জানায়, সার কারখানাগুলোর অর্ধেক যন্ত্রপাতিও যদি আধুনিক করা হয়, তবে আমদানির অর্ধেক ব্যয় হবে উৎপাদনে। বিসিআইসির পরিচালক (উৎপাদন ও গবেষণা) শাহীন কামাল বলেন, পলাশ ও ঘোড়াশালের কারখানা দুটি আধুনিকীকরণের কাজ শেষ হলে উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
কৃষি গবেষক রেজাউল করিম সিদ্দিক বলেন, বাংলাদেশে সারের দাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে বাজার নিয়ন্ত্রণ অধিকাংশই সরকারের হাতে থাকে। এখন সরকার সারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তার দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। সারের উপযুক্ত মৌসুমে কোনো রকম সংকট কাক্সিক্ষত নয়।
তিনি বলেন, এ সময়ে সংকট হলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, কমবে উৎপাদনও। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। শিল্প মন্ত্রণালয়কেও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্য, কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ বিশ্ববাজারের অজুহাতে বাংলাদেশে সারের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমরা প্রান্তিক পর্যায়ে শক্ত মনিটর করছি, যাতে সরকারের নির্ধারিত দামে সার বিক্রি হয়। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে সক্রিয় না থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্ত্রী জানান, বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও এ মুহূর্তে দেশে সারের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই। বরং ভর্তুকি বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সূত্র : এফএনএস