শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:০৭ pm
বঙ্গবন্ধুর পাবিারিক বন্ধন বাঙালি জাতির জন্য একটি অনুসরণীয় আদর্শ। তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থ দু’টিতে সুনিপণ হাতে তুলে ধরেছেন পারিবারিক বন্ধনের চিত্র। এছাড়াও তিনি নিজের তের বছর বয়সে মাত্র তিন বছর বয়সী তাঁর চির দুঃখিনী স্ত্রী রেণুর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ঘটনাবলীও ফুটিয়ে তুলেছেন কলমের আঁচড়ে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা রেণু-কে চির দুঃখিনী বলার কারণ অনেক। তার মধ্যে একটি হলো খুব অল্প বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে রেণু তাঁর মাকে হরান। একমাত্র সম্বল দাদাকেও হারান সাত বছর বয়সে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৭)।
শত দুঃখ-কষ্টের মাঝে ছেলের প্রতি নিজের মামা-বাবার আকুণ্ঠ সমর্থন প্রদানের চিত্রও বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে। জাতির পিতা তাঁর নিজের লেখা গ্রন্থদুটিতে পঞ্চান্ন বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে দীর্ঘ তেরো বছর জেল-জুলুমের চিত্র এবং সেই সময় তাঁর প্রিয় সন্তানদের দুঃখ বেদনাও তুলে ধরেছেন সাবলীলভাবে।
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে এই প্রবন্ধে সেই ঘটনাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরছি- ১৯৬৭ সালের এক ডায়েরিত বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ৮ ফেব্রুয়ারি দুই বছরের ছেলেটা (রাসেল) এসে বলে, “আব্বা বালি চলো”’। কি উত্তর ওকে আমি দিবো। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম। ওতো বুঝে না, আমি কারাবন্দি।
ওকে বললাম, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।” ও কি বুঝতে চাই! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে। দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চাই বাড়িতে (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২৪৯)।
আরেক ডায়েরিতে তিনি সন্তান ও তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কে লিখেছেন, …রেণুর শরীর ভালো না। পায়ে বেদনা, হাঁটতে কষ্ট হয়। ডাক্তার দেখাতে বললাম। রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে, ‘৬ দফা মানতে হবে-সংগ্রাম, সংগ্রাম চলবে চলবে- পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ভাঙ্গা ভাঙ্গা করে বলে, কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, “ও শিখলো কোথা থেকে?” রেণু বলল, বাসায় সভা হয়েছে, তখন কর্মীরা বলেছিল, তাই শিখেছে।” বললাম, “আব্বা, আর তোমাদের দরকার নাই এ পথের। তোমার আব্বাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুক (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২৪৬-৪৭)।
১৯৬৭ সালে এপ্রিলে তিনি লিখেছেন, জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভিতরে যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, “বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে।” রাসেল ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যে আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২২১)।
১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি এক ডায়রিতে লিখেছেন, ঈদ আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে আব্বা ও মায়ের কাছে বাড়িতেই করে থাকি। ছোট ভাই খুলনা থেকে এসেছিল আমাকে নিয়ে বাড়ি যাবে। কারণ কারও কাছে শুনেছিল ঈদের পূর্বেই আমাকে ছেড়ে দিবে। ছেলেমেয়ের মুখে হাসি নাই। ওরা বুঝতে শিখেছে। রাসেল ছোট্ট তাই এখনও বুঝতে শিখে নাই। শরীর ভালো না, কিছুদিন ভুগেছে। দেখা করতে এলে রাসেল আমাকে মাঝে মাঝে ছাড়তে চায় না। ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে কষ্ট হয়। আমিও বেশি আলাপ করতে পারলাম না, শুধু বললাম, “চিন্তা করিও না।
জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কত কাটাতে হয় ঠিক কী! তবে কোন আঘাতেই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে।” ওদের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় রেণুকে বললাম, বাচ্চাদের সবকিছু কিনে দিও। ভালো করে ঈদ করিও, না হলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২০১)।
১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে তিনি লিখেছেন, বিদায় নিয়ে রওয়ানা হলে গেটে দাঁড়িয়ে ওদের বিদায় দিলাম। গেট পার হয়েও রাসেল হাত তুলে আমার কাছ থেকে বিদায় নিল। বোধ হয় বুঝে গিয়েছে এটা ওর বাবার বাড়ি, জীবনভর ওখানেই থাকবে! (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১৫৯)।
অসমআপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু দুঃখ-বেদনা বিজড়িত পারিবারিক বন্ধনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তো তোমারও আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইলো।
বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যায় তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায় (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২০৯)।
১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, রেণু দেখা করতে এসেছিল। রেহানার জ্বর, সে আসে নাই। রাসেল জ্বর নিয়ে এসেছিল। হাচিনার বিবাহের প্রস্তাব এসেছে। রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছেলেটাকে পছন্দও করেছে। ছেলেটা সিএসপি। আমি রাজবন্দি হিসেবে বন্দি আছি জেনেও সরকারি কর্মচারি হয়েও আমার মেয়েকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। নিশ্চয়ই তার চরিত্রবল আছে। মেয়েটা এখন বিবাহ করতে রাজি নয়।
কারণ আমি জেলে, আর বিএ পাস করতে চাই। আমি হাচিনাকে বললাম মা আমি জেলে আছি, কতদিন থাকতে হবে কিছুই ঠিক নাই। তবে মনে হয় সহজে আমাকে ছাড়বে না, কতগুলি মামলাও দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে চলেছে। তোমাদের আবারও কষ্ট হবে। তোমার মা যাহা বলে শুনিও। রেণুকে বললাম, আর কি বলতে পারি? (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১৯৪)।
১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ৪৭তম জন্মবার্ষিকী ছিল। সেদিন তিনি তাঁর স্ত্রীকে জেলে গেটে মনেপ্রাণে দেখতে চেয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালার কৃপায় সেদিন রেণু এসেছিলেনও জেলগেটে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু এই স্মৃতিগুলো লিখেছেন এভাবে, ছয়টা বেজে গিয়াছে। তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলেমেয়েদের বিদায় দিতে হলো। রাসেলও বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না। আমার ছোট মেয়েটা খুব ব্যথা পায় আমাকে ছেড়ে যেতে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। ব্যথা আমিও পাই, কিন্তু উপায় নাই। রেণু বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২০৯- ২১১)।
১৯৬৭ সালের এক ডায়েরিতে জাতির পিতা লিখেছেন, ১৭ তারিখে রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। হাচিনাা আইএ পরীক্ষা দিতেছে। হাচিনা বলল, “আব্বা প্রথম বিভাগে বোধ হয় পাশ করতে পারব না তবে দ্বিতীয় বিভাগে যাবো।” বললাম, “দুইটা পরীক্ষা বাকি আছে মন দিয়ে পড়। দ্বিতীয় বিভাগে গেলে আমি দুঃখিত হব না, কারণ লেখাপড়া তো ঠিকমতো করতে পারো নাই (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২৪০)।
পরিশেষে বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রামের। বাংলার মানুষের অধিকার আদায়েরর সংগ্রামের মধ্যে থেকেও তিনি যে পারিবারিক আদর্শ আমাদের মাঝে রেখে গেছেন তা সকলের জন্য অনুকরণীয়। জেল জলুমের নিষ্পেষিত জীবনেও তিনি এক মহূর্ত্যরে জন্যও তাঁর পরিবার, পিতা-মাতা এবং সন্তানদেরকে ভুলেন নি। শেখ রাসেলের জন্মদিনে জাতির পিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক আদর্শই হোক বাঙালির আদর্শ। জয় বাংলা।
লেখক- মো. আবদুল কুদ্দুস, সহকারী অধ্যাপক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী, মোবাইল : ০১৭১৭৮৫৪১০৪, ইমেইল : [email protected]