শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৬:৫৪ am
নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগমারা : তুচ্ছ ঘটনায় প্রতিবেশী নারীকে মারধর মামলায় আদালত যখন সাজা দেন, তখন আসামি সায়মা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী জাকিরও একই মামলার আসামি। কয়েক মাস পরই মা হন ২৮ বছর বয়সী সায়মা। গত বছরের ১২ অক্টোবর এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় জাকির-সায়মা দম্পতিকে। তবে আদালত অপরাধীদের বয়স, অপরাধের ধরন, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ও পেশা বিবেচনায় প্রবেশন মঞ্জুর করে শর্তসাপেক্ষে বাড়িতেই থাকার সুযোগ দেন। ফলে সায়মা কারাগারের পরিবর্তে বাড়ি থেকেই একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। শিশুটির বয়স এখন ৬ মাস। জাকির ও সায়মা প্রবেশনকাল সফলভাবে সমাপ্ত করায় গত বুধবার মামলা থেকে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতিও পেয়েছেন।
এর আগে আদালতের নির্দেশে প্রবেশন অফিসার মতিনুর রহমান ও লাইজু সিদ্দীক নিয়মিত আসামিদের তত্ত্বাবধান করেন। একপর্যায়ে বাদী ও আসামি মুখোমুখি সমঝোতায় বসেন। সায়মা ও জাকির মামলার বাদী শিল্পীর কাছে ক্ষমাও চান। আঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পীকে আদালতের নির্দেশনা মতে ক্ষতিপূরণও দেন তারা। শিল্পীও তাদের ক্ষমা করে দেন।
শিল্পী বলেন, ছোটখাটো ঘটনার পর মারামারি হয়। আমি রাগের বশে মামলা করেছিলাম। কিন্তু এখন আপোস হওয়ায় আমাদেও সম্পর্ক ভালো হয়ে গেছে। দুপক্ষই আদালতে দৌড়াদৌড়ি থেকেও অব্যাহতি পেয়েছি।
শুধু সায়মা ও জাকির দম্পতিই নয়, একইদিন মামলা থেকে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি পেয়েছেন বাগমারা উপজেলার পানিশাইল গ্রামের গোলাম রব্বানী (২৫)। অভিযোগকারী আবুল কালামের বোনের সঙ্গে আসামির প্রেমের বিয়ের পর বিরোধের শুরু। ঘটনার দিনে আসামি গোলাম রব্বানী সাময়িক উত্তেজনার বশে আবুল কালামকে মারপিট করেন। এ ঘটনায় রাব্বানীসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ নিয়ে ভাই-বোনের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে গত বছরের ১৯ মার্চ রায় ঘোষণা করেন আদালত। কিন্তু আদালত গোলাম রাব্বানীকে কারাগারে না পাঠিয়ে অপরাধীর বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, মামলার প্রকৃতি ও গুরুত্ব বিবেচনায় এক বছরের প্রবেশন মঞ্জুর করে শর্তসাপেক্ষে বাড়ি থেকেই সংশোধনের সুযোগ দেন। প্রবেশনকালে আসামি নিজ এলাকার তিনজনকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তারা এখন নিজ নাম স্বাক্ষর করতে পারেন।
আদালতের শর্ত অনুযায়ী, রাব্বানী নিজ এলাকায় গাছও লাগিয়েছেন। আদালতের নির্দেশনার বাইরে করোনাকালে মাস্ক বিতরণসহ জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন। প্রবেশনকালে আসামি স্থানীয় স্কুল থেকে বই সংগ্রহ করে পড়েছেন এবং কী কী বই পড়েছেন- তার সারমর্ম আদালতে জমা দিয়েছেন। উভয় মামলা দুটি থেকে প্রবেশনপ্রাপ্ত আসামিদের চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি দেন রাজশাহীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলাম। এ পর্যন্ত রাজশাহী জেলায় ৫৫ জন এবং রাজশাহী মহানগর এলাকায় ১৫ জন মোট ৭০ জন এই আইনের অধীনে এমন সুবিধা পেয়েছেন। এর মধ্যে ৩০ জন সফলভাবে প্রবেশনকাল সমাপ্ত করেন। তবে দুজন প্রবেশনের শর্ত ভঙ্গ করায় কারাগারে সাজা ভোগ করেন। এই দুজনই ছিলেন মাদক মামলার আসামি।
সায়মা খাতুন বলেন, ‘গোবর শুকানো নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া ও মারধরের ঘটনা ঘটে। রায় ঘোষণার সময় আমি গর্ভবতী ছিলাম। এতে মানসিকভাবে আমি ভেঙে পড়ি। তবে আদালতের বিবেচনায় আমি প্রবেশনের সুযোগ পাই। ফলে কারাগারে না থেকে বাড়িতেই থেকে সন্তান জন্ম দিতে পেরেছি। বাদীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।’
প্রবেশন অফিসার মতিনুর রহমান জানান, এ আইনের মাধ্যমে আসামিদের সংশোধনের পাশাপাশি অপরাধের কারণ নির্ণয় করে পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। আসামিদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য চাহিদা মোতাবেক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন সেবামূলক কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হচ্ছে। ফলে অপরাধের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না। এখানকার প্রবেশনারদের অপরাধপ্রবণতার হার মাত্র ৬.৬৭ শতাংশ যা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের তুলনায় কম।
বেসরকারি সংস্থা ব্লাস্ট’র জেলা প্রকল্প কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট কানিজ ফাতেমা বলেন, প্রবেশন হচ্ছে অপরাধীদের সংশোধনের এমন একটি বিশেষ পদ্ধতি যেখানে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তিকে কারাগারে না পাঠিয়ে সমাজের নিজ পরিমণ্ডলে থেকে সংশোধন ও পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে শর্তসাপেক্ষে প্রবেশন অফিসারের অধীনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুক্তি দেওয়া হয় এবং যে কোনো শর্তভঙ্গ হলে স্থগিত সাজা ভোগের জন্য কারাগারে যেতে হয়।
রাজশাহী অ্যাডভোকেট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ তৌফিক জাহেদী জানান, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ ব্যতীত অন্য সব অপরাধে একজন নারীর প্রবেশন মঞ্জুর করা যেতে পারে। তবে পুরুষ বয়স্ক আসামিদের প্রবেশন দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।আজকের তানোর