শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:৪৫ pm
ডেস্ক রির্পোট : কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ড্রেন বা পানিতে বর্জ্য ফেললে বা খোলা জায়গায় বর্জ্য পোড়ালে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রেখে ‘কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১’ করেছে সরকার। সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
বিধিমালায় বর্জ্য সৃজনকারী এবং ব্যবহারকারীর দায়িত্ব, প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, পণ্য প্রস্তুতকারক বা আমদানিকারকের দায়িত্ব, স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
উৎপাদনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্বের (ইপিআর) আওতায় জৈবিকভাবে অপচনশীল পণ্যের প্রস্তুতকারী বা আমদানিকারকদের বর্জ্য নিঃশেষ (ডিসপোজ) বা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করার (রিসাইক্লিং) ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে অংশ নিতে হবে। বিধিমালা অনুযায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অর্থায়নসহ প্রয়োজনে জনবলও দিতে হবে প্রস্তুতকারীদের।
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অনুবিভাগ) কেয়া খান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা অনেক কিছুই এই বিধিমালার মধ্যে এনেছি। বিধিমালাটি বাস্তবায়ন করা গেলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আরও উন্নতি আসবে বলে মনে করি।
তিনি বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটি মূলত স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন সিটি করপোরেশন করে। এই দায়দায়িত্ব তাদেরই। পৃথিবীর সব দেশেই প্লাস্টিকসহ অপচনশীল বর্জ্য রয়েছে। আমাদের সমস্যা হলো আমরা সেটা ম্যানেজ করতে পারি না। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা বিধিমালাটি করেছি।
‘বিধিমালার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে- এক্সটেন্ডেড প্রডিউসার রেসপন্সিবিলিটি (ইআরপি)। যাদের পণ্য থেকে বর্জ্যের সৃষ্টি হচ্ছে তাদের দায়-দায়িত্বের মধ্যে আনা হয়েছে। বর্জ্য রিসাইক্লিং ও ডিসপোজালের ক্ষেত্রে তাদের দায়-দায়িত্ব ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। ইপিআরের মাধ্যমে এটা করা হবে। বিধিমালায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
ড্রেন ও রাস্তায় বর্জ্য ফেললে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, এসব বিষয় আরোপ করে মানুষকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা ও সচেতন করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এক গবেষণার ফলাফল মতে, বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে ১৯৯১ সালে যেখানে প্রতিদিন ৯ হাজার ৮৭৩ টন বর্জ্য উৎপাদিত হতো সেখানে ২০০৪ সালে ১৬ হাজার ৩৮২ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে। এহারে বাড়তে থাকলে ২০২৫ সালে প্রতিদিন উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৭ হাজার ৬৪ টন।
গঠন প্রকৃতি অনুযায়ী বাংলাদেশে কঠিন বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে- খাদ্য এবং শাকসবজি, কাগজ দ্রব্যাদি, প্লাস্টিক, লেদার, রাবার, মেটাল, গ্লাস এবং সিরামিক, কাঠ/খড়/পাতা, মেডিসিন/কেমিক্যাল, পাথর, ধূলি বিবিধ।
কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই বিধিমালার বিধি ৭, বিধি ৮ এর উপবিধি (১), (২) ও (৪) এবং বিধি ৯ এর উপবিধি (১), (৪) ও (৮) এর বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
বর্জ্য সৃষ্টি এবং ব্যবহারকারীর দায়িত্ব
বিধিমালার ৭ বিধিতে বর্জ্য সৃজনকারী এবং ব্যবহারকারীর দায়িত্বে বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশন, পৌর এলাকা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় বসবাসরত বর্জ্য সৃজনকারী এবং ব্যবহারকারীকে নিজ কর্মস্থল বা আবাসস্থলে সৃষ্ট সব বর্জ্য স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পদ্ধতিতে ফেলতে হবে।
জৈবিকভাবে পচনশীল, অপচনশীল এবং গার্হস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন বর্জ্য আলাদা করে আঙিনা বা স্থাপনায় ভিন্ন ভিন্ন ঢাকনাযুক্ত তিনটি পাত্রে সংরক্ষণ করে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত শ্রেণির বর্জ্যের জন্য নির্দিষ্ট করা ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। বর্জ্যের কোনো অংশ খোলা রাখা যাবে না।
অবকাঠামো নির্মাণ ও ভাঙন থেকে সৃষ্ট বর্জ্য স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার আগে পর্যন্ত আলাদা রাখতে হবে, যাতে ধুলাবালি বাতাসে ছড়াতে বা বৃষ্টির পানির মাধ্যমে ড্রেনে পড়তে না পারে।
একক বা সম্মিলিতভাবে সৃষ্ট বর্জ্য আঙিনার বাইরে রাস্তা, খোলা জায়গা, ড্রেন বা পানিতে নিক্ষেপ না করা এবং খোলা স্থানে না পোড়ানো এবং পার্ক, স্টেশন, টার্মিনাল বা জনসমাগমস্থলে নির্দিষ্ট ডাস্টবিন ছাড়া যত্রতত্র কঠিন বর্জ্য নিক্ষেপ করা যাবে না বলে বিধি-৭ এ উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব
প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়ে বিধি-৮ এর (১)-এ বলা হয়েছে, দোকান, রেস্টুরেন্ট, হোটেল, মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার ও অন্যান্য আবাসিক, বাণিজ্যিক বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের ময়লা-আবর্জনা জমা করে নির্ধারিত জায়গায় ফেলা নিশ্চিত করতে হবে।
বিধি-৮ এর (২)-এ বলা হয়েছে, বর্জ্য রাস্তায বা ড্রেনে নিক্ষেপ বা বর্জ্য পোড়ানো যাবে না। বিধি-৮ এর (৪)-এ রয়েছে, স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে উৎস থেকে বর্জ্য আলাদা করা, আলাদা করা বর্জ্য আলাদাভাবে সংগ্রহের সুবিধা দেওয়া, পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য অনুমোদিত বর্জ্য সংগ্রহকারী বা অনুমোদিত পুনর্ব্যবহার উপযোগীকরণকারীর কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বের মধ্যে আরও রয়েছে- বর্জ্য নিক্ষেপের জন্য প্লাস্টিকজাত ব্যাগের ব্যবহার রোধ করা এবং জৈব পচনশীল ব্যাগ বা মোড়ক ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পচনশীল বর্জ্য নিজের আঙিনায় গর্ত করে কম্পোস্টিং বা বায়ো-মিথেনেশানের মাধ্যমে যতদূর সম্ভব প্রক্রিয়াকরণ ও ফেলা এবং অবশিষ্ট বর্জ্য কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত বর্জ্য সংগ্রহকারী বা সংস্থাকে দিতে হবে।
পণ্য প্রস্তুতকারক বা আমদানিকারকের দায়িত্ব
বিধি-৯ এর (১)-এ বলা হয়েছে, উৎপাদনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্বের (ইপিআর) আওতায় জৈবিকভাবে অপচনশীল ডিসপোজেবল পণ্যের প্রস্তুতকারী বা আমদানিকারকদের টিন, গ্লাস, প্লাস্টিক, সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক, পলিথিন, মাল্টিলেয়ার প্যাকেজিং বা মোড়ক, বোতল, ক্যান বা সমজাতীয় পণ্যের মাধ্যমে সৃষ্ট বর্জ্য গ্রাহক পর্যায় থেকে সংগ্রহ করে, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, পুনঃচক্রায়নসহ নিঃশেষের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিধি-৯ এর (৪)-এ রয়েছে নিজস্ব উদ্যোগে বা স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অর্থায়নসহ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। বিধি-৯ এর (৮)-এ বলা হয়েছে, পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের সময় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পণ্যের সৃষ্ট বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ক্রেতা বা ভোক্তার করণীয় সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।
এছাড়া পণ্য প্রস্তুতকারক বা আমদানিকারকের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে- সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় জনগণের করণীয় বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন, বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবেশসম্মত পরিত্যজন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উৎপাদনকারীকে সম্প্রসারিত দায়িত্বের নির্দেশিকা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। নিজস্ব অর্থায়নে উৎপাদনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্ব বাস্তবায়ন বা সমন্বয় সাধনে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগসহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
একইসঙ্গে প্রস্তুতকারক বা আমদানিকারকের প্লাস্টিক পুনঃচক্রায়নের পরিমাণ সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রতি বছরের মার্চ মাসে মহাপরিচালকের কাছে দিতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব
বিধিমালায় বলা হয়েছে, পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সম্পাদন এবং তফসিলের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষকে। বর্জ্য হ্রাস, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়নসহ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জাতীয় কৌশল এবং নির্দেশনা অনুসরণে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
নিজেদের ব্যবস্থাপনায় বা নিয়োজিত ব্যক্তি, ঠিকাদার সমিতি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রতিটি বাড়ি অথবা অন্য কোনো উৎস থেকে জৈবিকভাবে পচনশীল এবং অপচনশীল কঠিন বর্জ্য, গার্হস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন বর্জ্য তিন শ্রেণিতে আলাদাভাবে সংগ্রহ, পরিবহন ও ব্যবস্থাপনা করতে হবে। নির্ধারিত স্থানে বর্জ্য ফেলা, স্তূপীকরণ এবং পোড়ানোর ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করতে হবে।
আবাসিক এলাকা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বিনোদন কেন্দ্র, পার্ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প-কারখানা, কসাইখানা, মৎস্য, ফল ও সবজি বাজার বা আড়ত থেকে পচনশীল বর্জ্য সংগ্রহ এবং আলাদা করে নির্ধারিত স্থানে কম্পোস্টিং বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা করতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রতি অর্থবছরের বার্ষিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিবেদন (অ্যানুয়াল ওয়েস্ট রিপোর্ট) নামে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে এবং প্রতি অর্থবছরের শেষে পরবর্তী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বার্ষিক প্রতিবেদন কমিটির কাছে দাখিল করবে।
সরকার, জাতীয় সমন্বয় কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিচ্ছন্নতা তথা পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের জন্য স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রতি বছর প্রশংসনীয় বা অনুকরণীয় কাজের স্বীকৃতি দিতে পদক্ষেপ নেবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বিধিমালা বাস্তবায়নে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে ২১ সদস্যের একটি কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হবে। সরকার জাতীয় সমন্বয় কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে তদারকি কমিটি গঠন করতে পারবে বলে বিধিমালায় জানানো হয়েছে।
বিধিমালার চারটি তফসিলে গার্হস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন বর্জ্যের শ্রেণির তালিকা, কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ নির্দেশনাবলি, ল্যান্ডফিল বিষয়ক নির্দেশনাবলি, বর্জ্য থেকে জ্বালানিতে রূপান্তরের মানদণ্ড, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্র : জাগোনিউজ