বৃহস্পতিবর, ১২ িসেম্র ২০২৪, সময় : ১২:০৮ am
নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজশাহীতে আবাদের ভরা মৌসুমে আলু বীজ সংকটের পর এবার সার নিয়ে হাহাকার পড়েছে। এক দুই বস্তা সার সংগ্রহ করতে গিয়ে চাষিদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। দিতে হচ্ছে বেশি টাকা। এদিকে রাজশাহীতে সার বিতরণে রাজনৈতিক নেতাদের অনাকাংক্ষিত হস্তক্ষেপের কারণে ডিলারদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
চাষিদের অভিযোগ, এবারই প্রথম রাজনৈতিক নেতারা ডিলারদের বরাদ্দ থেকে অধিকাংশ সার নিয়ে নিচ্ছেন। সেই সার তারা আবার বেশি দামে বিক্রি করছে চাষিদের কাছে। ডিলাররা বলছেন, তারা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ঠিকমতো সার দিতে পারছেন না চাষিদের। এক্ষেত্রে তারা অসহায়।
রাজশাহীর তানোর, পবা ও মোহনপুর উপজেলা এলাকার চারজন আলু চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে আলুর চড়া দামের কারণে এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে। এ কারণে আমন ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে জমি তৈরি করছেন চাষিরা। আলু বীজ সংকটের মধ্যে এবার চাষিদের সার কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোথাও চাহিদা মতো সার পাচ্ছেন না তারা। ক্ষেত্র বিশেষে বস্তা প্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে বেশি দিয়ে সার সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। ফলে আলু আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় ৩৫ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে চারদিকে আলু চাষের হিড়িক পড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত আরও সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমি আলু চাষের আওতায় আসছে।
মৌসুম শেষে ৩৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি আলু আবাদের আওতায় আসবে বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের আশা। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এই পরিমাণ জমি থেকে রাজশাহীতে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পুনর্র্নিধারণ করা হয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় আলু ফলনের এ লক্ষ্যমাত্রা সর্বোচ্চ।
তানোর উপজেলার কামারগাঁও এলাকার আলু চাষি নজরুল ইসলাম বলেন, এক বিঘা আলু আবাদে দুই বস্তা পটাশ, এক বস্তা টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) ও এক বস্তা ডিএপি দানাদার সারের প্রয়োজন। এতে আলুর ভালো ফলনের আশা থাকে। গত ২২ নভেম্বর সকালে কামারগাঁও বাজারের বিসিআইসি সার ডিলার মৌসুমী ট্রেডার্সের দোকানে চাষিরা সার কিনতে গিয়ে দেখতে পান স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা প্রভাব খাটিয়ে ট্রলিতে করে ভরে সার নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু চাষিদের কাছে সার বিক্রি করা হচ্ছে না। এ সময় শতাধিক আলু চাষি সারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
সার না পেয়ে বিক্ষুব্ধ চাষিরা ডিলারের ম্যানেজার বিধান চন্দ্র দাসকে প্রথমে অবরুদ্ধ ও পরে শারীরিকভাবে হেনস্তা করেন। পরে ডিলার বিকাশ কুমার দাস নিজে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। শেষে চাষিদের এক বস্তা করে সার দিয়ে শান্ত করা হয়। ডিলার বিকাশ কুমার দাস বলছেন, এবার চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কিছুটা কম। তার ওপর প্রভাবশালী কেউ কেউ বেশি পরিমাণে সার নিতে চাপ দিচ্ছেন। আমরা বাধ্য হয়ে দিচ্ছি।
আরও কয়েকজন ডিলার বলেছেন, হঠাৎ করেই কতিপয় রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। তারা দলের পরিচয় দিয়ে ডিলারদের কাছ থেকে সার নিচ্ছেন বেশি পরিমাণে। তারা চাষি কিনা- সেটাও বুঝতে পারছি না।
তানোরের আলু চাষিদের আরও অভিযোগ, কতিপয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কৃষি অফিসের কথা বলে ডিলারদের কাছ থেকে একসঙ্গে ২০-৩০ বস্তা করে সার নিয়ে যাচ্ছেন। ওই সার তারা বেশি দামে চাষিদের কাছে বিক্রি করছেন।
চৌবাড়িয়া গ্রামের আলু চাষি সাহারুল হক অভিযোগে বলেন, আগে কোনো দিন এমনটা দেখা যায়নি। কিন্তু এবার দেখছি নেতারা প্রভাব খাটিয়ে বরাদ্দ সারের বেশিরভাগ নিয়ে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু তানোর নয়-পার্শ্ববর্তী পবা ও মোহনপুর উপজেলা এলাকায়ও এমন ঘটনা ঘটছে। এক বস্তা সার কিনতে চাষিরা নেতাদের কাছে ছুটে যাচ্ছেন। রাজশাহীর বাগমারা, দুর্গাপুর ও গোদাগাড়ী এলাকায়ও সার নিয়ে কাড়াকাড়ি পরিস্থিতি চলছে। চাষিরা আলুর জমি তৈরি করে সারের অভাবে বীজ রোপণ করতে পারছে না।
এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাষি পর্যায়ে ৫০ কেজির এক বস্তা পটাশের সরকারি দাম ১ হাজার টাকা। কিন্তু রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে এক বস্তা চাষিদের কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা করে। অন্যদিকে চাষি পর্যায়ে এক বস্তা টিএসপির সরকারি দাম ১ হাজার ২৫০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে একবস্তা টিএসপি সার চাষিদের কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি বস্তায় চাষিদের অতিরিক্ত ৩৫০ টাকা গুণতে হচ্ছে।
এদিকে ৫০ কেজির এক বস্তা ডিএপি সারের চাষি পর্যায়ে সরকারি দাম ১ হাজার ৫০ টাকা। তবে রাজশাহীর সর্বত্রই এই সার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৫০ টাকা ১ হাজার ৫০০ টাকা করে। এক বস্তা ডিএপি কিনতে চাষিদের ৪৫০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে।
জানা গেছে, রাজশাহী জেলাজুড়ে বিসিআইসি অনুমোদিত ২১৯ জন সার ডিলার রয়েছেন। অন্যদিকে বিএডিসি অনুমোদিত ডিলারের সংখ্যা ১৩০ জন। বিসিআইসির এসব ডিলারের মাধ্যমে পটাশ টিএসপি ডিএপি ও ইউরিয়া সার বিতরণ করা হয়। তবে বিএডিসির ডিলাররা ইউরিয়া সার বরাদ্দ পায় না। বাকি তিনটি সার তারা বরাদ্দ পায় ও বিক্রি করেন।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর মোট ৩৪৮ জন ডিলারের মধ্যে চলতি নভেম্বর মাসে ২ হাজার ৮০৬ মেট্রিকটন টিএসপি ও ৫ হাজার ৪৩২ মেট্রিকটন এমওপি সার বরাদ্দ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে চলতি মাসের সব সারই উত্তোলন সম্পন্ন হয়েছে। তবে, এরপরও সারের সংকট কাটেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, চলতি আলু আবাদে চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী সার বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে, কোথাও বিতরণে কোনো সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। সেটি আমরা নিবিড় তদারকির মাধ্যমে মনিটরিং করছি। বেশি দামে সার বিক্রি করলে এবং সেটা প্রমাণিত হলে ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রা/অ