রবিবর, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:০১ am
নিজস্ব প্রতিবেদক :
চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাঞ্চল্যকর যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম জেম হত্যায় জড়িত বেশ কয়েজন সন্ত্রাসী আগে দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার ছিলেন। কেউ কেউ অন্য দলও করতেন। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের সময় শহরজুড়ে চলা ভয়াবহ নাশকতার নেতৃত্বেও ছিল তাদের কয়েকজন।
তবে ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সংসদ-সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ বিশ্বাসের হাত ধরে তারা আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এসব সশস্ত্র ক্যাডারকে বরণ করতে ওদুদ বিশ্বাস শহরের কাঁচাবাজারে যোগদান অনুষ্ঠান ও প্রীতি ভোজের আয়োজন করেন।
জানা যায়, ওই অনুষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের শতাধিক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। অভিযোগ রয়েছে, নিজের রাজনৈতিক বলয় শক্তিশালী করতে তাদেরকে আওয়ামী লীগে যোগদান করান ওদুদ। এ সংক্রান্ত বেশকিছু ছবি এসেছে যুগান্তরের হাতে। তাতে দেখা যায়, যুবলীগ নেতা হত্যায় জড়িত কয়েকজনকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন এমপি ওদুদ। নিহত জেমের ভাই মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে সদর থানায় যে মামলা করেছেন তাতে এসব ক্যাডারের অধিকাংশই আসামির তালিকায় আছেন।
আরও জানা যায়, দলে আসা এই সন্ত্রাসীদের পরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে পদ-পদবি দেওয়া হয়। দলে ভিড়ে তারা হয়ে ওঠেন এমপি ওদুদের সার্বক্ষণিক সহযোগী। তবে সময়ের ব্যবধানে চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব শুরু হলে ওদুদ তাদের বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কয়েক মাস আগে এসব ক্যাডার ওদুদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোখলেসুর রহমানের কাছে আশ্রয় নেন।
ওদুদের বিরুদ্ধে তারা প্রায়ই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিতেন। এসব নিয়ে প্রায়ই চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে বোমাবাজি ও পালটা বোমাবাজি, হামলা-পালটা হামলার ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় শহরের উদয়ন মোড়ে এসব সন্ত্রাসী এমপি ওদুদের সেকেন্ড ইন কমান্ড যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম জেমকে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যা মিশনে অংশ নেওয়া অধিকাংশ সন্ত্রাসীর রয়েছে বিভিন্ন অপরাধের দীর্ঘ রেকর্ড। এছাড়া নিহত জেম পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিলেন বলে জানা গেছে। তার নামে বিভিন্ন থানায় হত্যাসহ ১৬টি মামলা রয়েছে।
সূত্র জানায়, জেম হত্যায় জড়িত টুটুলসহ ১০-১২ শীর্ষ ক্যাডারকে এক সময় জেমই নিয়ন্ত্রণ করতেন। জেম ২০১৯ সালে শিবগঞ্জের মর্দানা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে এসে এমপি ওদুদের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে শহরের ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পান। একপর্যায়ে ক্যাডারদের সঙ্গে বিভিন্ন স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন জেম। শেষে ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় তাদের হাতেই নৃসংশভাবে খুন হন জেম।
সূত্র আরও জানায়, জেম হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৫নং আসামি মাসুদ রানা এ সময় দুর্র্ধষ শিবির ক্যাডার ছিলেন। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এমপি ওদুদের হাতে ফুল দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। রানার বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে ৫টি মামলা রয়েছে। দলে যোগদানের পর তাকে সদর উপজেলা কৃষক লীগের সদস্য করা হয়।
জেম হত্যায় গ্রেফতার হয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন রানা। জেম হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৪৬নং আসামি নুরে আলমও সাবেক শিবির ক্যাডার। কয়েক মাস আগেও তাকে এমপি ওদুদের সঙ্গে দেখা গেছে। নুরে আলম ওদুদের ঘনিষ্ঠ বাবা রুহুলের অনুসারী বলে জানা গেছে। এছাড়া মামলার ৬নং আসামি সাবেক শিবির ক্যাডার শামীমও একই দিনে আওয়ামী লীগে যোদ দেন। এরপর থেকে শহরে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও বোমাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়ান তিনি।
অন্যদিকে মামলার ৪৫নং আসামি মো. আমিন (৪৫) আগে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি করতেন। ২০১৭ সালে ওদুদের হাত ধরে আওয়ামী লীগে আসেন। জেম হত্যায় জড়িত ও মূল পরিকল্পনাকারী মেসবাহুল হক টুটুল এক সময় শহরে ওদুদের প্রধান ক্যাডার ছিলেন। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শিবির নেতাদের সঙ্গে তিনিও আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
টুটুলের বিরুদ্ধে হত্যা ছিনতাইসহ এক ডজন মামলা রয়েছে। ওদুদ এমপির সার্বক্ষণিক সহযোগী টুটুল মাসখানেক আগে পক্ষ ত্যাগ করে নিজেই পৃথক একটি সশস্ত্র ক্যাডার গ্রুপ তৈরি করেন। টুটুল গ্রেফতার হয়ে জেম হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
জবানবন্দিতে টুটুল বলেন, গত ৫ ডিসেম্বর পৌর পার্কে অনুষ্ঠিত জেলা কৃষক লীগের তিনি সাধারণ সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন। এমপি ওদুদ এই পদে চেয়েছিলেন তার সেকেন্ড ইন কমান্ড খাইরুল আলম জেমকে (নিহত)। ওইদিন কাউন্সিলে জেম গ্রুপ ও টুটুল গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। সেই থেকে জেমের সঙ্গে টুটুল গ্রুপের দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠে। শহরে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে তারা জেমকে হত্যা করেন।
এদিকে জেম হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া রোকন ঘটনার সময় বিএনপি নেতা ও ঠিকাদার রুনুর মোটরসাইকেলটি ব্যবহার করেন। ওই মোটরসাইকেলটি পুলিশ সম্প্রতি গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ থেকে উদ্ধার করেছে। হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৭নং আসামি বেলাল বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসেন এমপি ওদুদের হাত ধরে। বাকি আসামিদের অধিকাংশকেই শহরে ওদুদ অনুসারী হিসাবে চিনতেন এলাকাবাসী।
১ ফেব্রুয়ারি সদর (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩) আসনের উপনির্বাচনে ওদুদ এমপি হলে জেমের মাধ্যমে বেলাল গোটা শহর ছাড়াও জেলার হাট-ঘাট-বালুমহল নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এ নিয়ে টুটুল গ্রুপের সঙ্গে বিরোধ চরমে ওঠে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেন জানান, খাইরুল আলম জেম হত্যা মিশনে অংশ নেওয়া টুটুলসহ ১০ থেকে ১২ জন গ্রেফতার হয়েছে। তারা জেম হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। গ্রেফতার হওয়া অধিকাংশেরই বিভিন্ন অপরাধের দীর্ঘ রেকর্ড রয়েছে। নিহত জেমও একটি পৃথক সন্ত্রাসী গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করতেন।
এসব ক্যাডার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নেতার শেলটারে থেকেছে। শহরে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে জেম খুন হয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সন্ত্রাসীদের দলে টানার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সংসদ-সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ বলেন, আমার হাত ধরে তারা দলে আসেনি। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে ফুল নেওয়ার ছবি থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেকেই অনেক সময় দলে এসেছে। আমরাও দলে নিয়েছি। আবার বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওদুদ দাবি করেন, জেম আগে থেকেই জানতেন যে তাকে হত্যা করা হতে পারে। পুলিশকে আগে জানিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি। সূত্র : যুগান্তর