শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০১:৪৬ pm
এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন : অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তা হলো বাংলাদেশের সাথে পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের সম্পর্ক, সু-সম্পর্ক আছে। কিন্তু, কোন দেশের সাথে ‘নীতি’ দাঁড় করাতে পারেনি। এমন অনুযোগের জবাব দেয়া যাচ্ছে বলে মনে করা যাচ্ছে।
এদিকে পররাষ্ট্র-সম্পর্ক এক বিষয়। পররাষ্ট্রনীতি আরেক বিষয়। একান্ন বছরের বাংলাদেশ গেল কয়েক বছর ধরেই জানান দিয়েছে, আমরা বৈশ্বিক নীতি গ্রহণ করতে যাচ্ছি। এখন তা ধীরে ধীরে বাংলাদেশের শরীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। যুক্ত হয়েছে নতুন ডানা। তেমন ডানায় ভর করে বাংলাদেশ এখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ছাড়িয়ে চীনের আকাশেও উড়বে।
আমাদের প্রিয় মানুষ- জননেত্রী শেখ হাসিনাই সেই ডানা জুড়ে দিয়েছেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সেই মহান নেত্রী, যিনি প্রমাণ করতে পেরেছেন যে, বৈশ্বিক পর্যায়ে ভূ-রাজনীতির বাস্তবতায় বাংলাদেশ কারো শিকার হয়ে নয়, বরং নিজস্ব চাহিদা ও মূল্য তৈরি করে বলতে পারছে, ‘দেখা যাক!’
অতি উচ্চমানের রাষ্ট্রনায়ক হয়ে শেখ হাসিনা পরাক্রমদের আবেদন ও মিত্র বন্ধনের প্রস্তাবগুলোকে ‘দেখা যাক’ বলার মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে পররাষ্ট্রনীতি দাঁড় করাতে সচেষ্ট হয়েছেন বলে অনুমিত হয়। সময় নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এখন দক্ষিণ এশিয়াসহ পশ্চিমা বিশ্বও পরখ করতে পারবে। তারা অবলোকন করবে এবং দেখবে কিভাবে বাংলাদেশ তার দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এগিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ- দুইটি দেশের সম্পর্ক খুঁজতে গেলে ঐতিহাসিকতার প্রশ্নে মধুময় উল্লেখ করলে প্রহসন করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র অতি উৎসুক হয়ে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক কিছু করতে চাইলেও, জনশ্রেণি এমন উদ্যোগকে সু-স্বাগত বলবার অভিপ্রায়ে থাকবে না। বাঁকা চোখে দেখবে। কিন্তু দেশের একটি ছোট্ট বলয় আছে, যাদের পেশাজীবন সমৃদ্ধ হয়েছে এনজিও ব্যবসার মাধ্যমে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপপ্রত্যাশী হয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকার কায়েম করতে অত্যুৎসাহী।
শেখ হাসিনা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রায় একযুগ ধরে এই সব ‘সুশীল’দের মতলব রুখে দিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ফলে তার নেতৃত্ব নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের টেবিলেও আলোচনা হয়। তারা তখন হয়তো মন খারাপ করে বলে, আমরা আফগানিস্তান, ভিয়েতনামে গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছি কিন্তু বাংলাদেশে পারা গেল না!
এই পারা-টা গেল না কেন ? একজন শেখ হাসিনাই তাদের প্রধান বাধা। সঙ্গত কারণে, যুক্তরাষ্ট্র যতই বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে- এসব বলে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতে মনোযোগী হোক না কেন এবং তাদের কিছু এজেন্ট ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি হেসে রাজনীতি করতেও চাক না কেন, শেখ হাসিনার সরকার অবলীলায় এদেরকে মোকাবিলা করতে জানে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষও যুক্তরাষ্ট্রের অহেতুক আধিপত্যকে আমলে নেয় না। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্রেই ১৯৬০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২ লাখ হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। ওয়াশিংটন পোস্টের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলছে, দেশটিতে প্রতি তিনটি খুনের একটিতে অপরাধীদের পুলিশ পর্যন্ত শনাক্ত করেনি, বা করতে পারেনি।
দেশের একটি ছোট্ট বলয় আছে, যাদের পেশাজীবন সমৃদ্ধ হয়েছে এনজিও ব্যবসার মাধ্যমে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপপ্রত্যাশী হয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকার কায়েম করতে অত্যুৎসাহী
সেই যাই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আলাদা করে বলার কিছু নেই। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বিবেচনা করা উচিত যে, এই দেশে জঙ্গিবাদ দমনে সফল হওয়া যাচ্ছে কিনা, ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বলে কিছু আছে কিনা! এসব এখন কার্যত অতীত। তবু অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের অনুশীলনে থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক সুবিধা নেওয়া ও ওষুধ শিল্পের স্বার্থরক্ষায় বাণিজ্য সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে চায় বাংলাদেশ।
অতি অবশ্যই অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট এও প্রমাণ করে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মিত্র বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জঙ্গিবাদ বিরোধী অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে দুইটি রাষ্ট্রই বেশকিছু সহায়তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট ২০১৫ সালে দুই দেশের সম্পর্ককে ‘স্পন্দনশীল, বহুমুখী এবং অপরিহার্য’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ রাজনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নের ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে দক্ষিণ এশিয়ার ওপর দেশ ভারতের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছে, “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় দুইটি দেশের মধ্যকার একটি অলিখিত চুক্তি করে গণমুক্তির সড়কে পথিক হয়ে উভয় দেশই এগিয়ে যাচ্ছি। যে মুক্তি ফলত সামাজিক নিরাপত্তাকে ঘিরে পরিবেষ্টিত। তোমরাও আমাদের পাশে থাকো।”
চল্লিশের দশকের শেষ বছরে সংঘটিত চীনা বিপ্লবের অব্যবহিত পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এক নতুন রূপ নেয়। এ সম্পর্ক রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ ছিল না; এটা ছিল আদর্শিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের বামপন্থি আন্দোলনের শিকড়সূত্রে। কিন্তু, সময় বদলেছে।
বাংলাদেশে বামধারার রাজনীতির ব্যর্থতা ও গণতন্ত্রের গড়পরতা রেওয়াজে একটি নতুন সুর ধ্বনিত হচ্ছে। সেই সুরের গায়েনের নাম শেখ হাসিনা। যখন শ্রেণি সংগ্রামের লড়াই করার কথা চীনপন্থি রাজনৈতিক বলয়ের, তখন একজন শেখ হাসিনা বললেন, বড় ক্যানভ্যাসে ভেসে যেয়ে আমাদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমে শাসক হয়েই বিজয়ী হতে হবে। বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত মানুষ যখন সুখে থাকার বন্দোবস্তে চলে যায়, ঠিক তখন থেকেই চীনের সাথে বাংলাদেশের বন্ধু সম্পর্ক তৈরি হয়।
সূত্র বলছে, চীন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেশি। চীন থেকে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য সামগ্রী আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশ মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে।
তবে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে চীনের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের উপর শুল্ক ছাড় দিয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ঘাটতি কিছুটা হলেও কমবে।
কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একুশ শতকের শুরুতেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, চীন তাদের ২০২০ পর্যন্ত অর্থনৈতিক লড়াইয়ে গুরুত্ব দিবে এবং এর পরেই খোলস ছেড়ে সমরনীতি গ্রহণ করবে। তেমন আলামত স্পষ্ট হচ্ছে। এখন ২০২২ সাল। ভূ-রাজনীতির অনিবার্য বাস্তবতায় বাংলাদেশ এখন চাহিদাসম্পন্ন দেশ চীনের কাছে।
রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশকেই তাদের লাগছে। তাদের সামরিক নীতি রয়েছে, আর সেই প্রতিরক্ষানীতির সফলতা অর্জনে শেখ হাসিনার বাংলাদেশকে জোর করে হলেও ভালবাসতে হচ্ছে। একজন শেখ হাসিনা তাই বিচক্ষণতার সাথে চীন-বাংলাদেশ অতীত সম্পর্ককে ছাপিয়ে গিয়ে দেশটির সাথে কার্যকর পররাষ্ট্রনীতি দাঁড় করিয়েছে বলে মনে করার সুযোগ আছে।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য, বিপরীতে আমদানি করা হয়েছে ৪৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাশিয়ার ঋণ সহায়তা ১০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি ছিল। রাশিয়া বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অন্যতম।
দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে শেখ হাসিনা ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যকার একটা অর্থবহ রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে, তা রাষ্ট্রনায়কদের আভিজাত্যের ক্লাব পাড়ায় আলোচনা রয়েছে। এমনিতেই মহান মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার আদর্শিক অবস্থান বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষগুলোকে এবং খোদ বঙ্গবন্ধুকে স্বস্তি দিয়েছিল। রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক অটুটই নয়, ‘দুই দেশ নীতি’ প্রণয়ন করে এগোচ্ছে বলে মনে করার সুযোগ আছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ধারাভাষ্য দেওয়ার কিছু নেই। তবে, গেল পঞ্চাশ বছরের নতজানু নীতি আবহে কেবল ‘সম্পর্ক’ উপলক্ষ ঘিরে আবর্তিত নয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বর্তমান বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা ভারতের সাথে কিভাবে চলবেন, সেই নীতি গ্রহণ করেছেন, বিদগ্ধ জনশ্রেণি ধীরে ধীরে তা বুঝতেও পারবে।
বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় শেখ হাসিনা তার শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনা তুলে রেখেছেন বলে মনে করার সুযোগ আছে। বাংলাদেশকে তিনি আরও অনেক কিছু দিবেন বলে আশা করা যায়। সেই সামর্থ্য তার রয়েছে। এই তো সেদিন তিনি দিল্লি গেলেন। দুই দেশের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা নীতির সুমসৃণ পথচলায় বাংলাদেশকে তাদের প্রয়োজন।
শেখ হাসিনা বৈশ্বিক রাজনীতির রঙ বুঝেই নীতি দাঁড় করাতে এখন অভ্যস্ত। তবে সবার আগে তার মন অতিমানবিক সত্তায় বিভোর থেকে ব্যক্তিবিশেষবর্গ-কে সম্মান জানায়। শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে শেখ হাসিনা আত্মকেন্দ্রিক নন। অথচ, এই দেশে ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী একজন রাজনৈতিক নেত্রীর সাথে দেখা করতে চাইলেও, রাজনৈতিক সুবিধা হবে না বলে ওই নেত্রী নিছক শিষ্টাচার প্রদর্শনেও না থেকে দেখাই করেননি।
অথচ, জীবনের রাজনৈতিক আলেখ্য সাক্ষ্য দেয়, আজকের প্রণব পরিবারের কোনও সদস্য আমাদের যে কারোর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলে তার সাথে আমাদের কিংবা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহাসিকতা উঁকি দিয়ে বলবে, যাও দেখা কর। এখানেই রাজনীতির সৌন্দর্য।
লেখক- রাজনীতিবিদ, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও মেয়র, রাজশাহী সিটি করপোরেশন। সূত্র : পদ্মাটাইমস