শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:৫৬ am
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন বিশ্বজুড়েই একটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম। এরমধ্যে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি, যদিও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহারের সংখ্যা ওঠানামা করে। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সাধারণ দৃষ্টিতে ফেসবুক ইউজার সবচেয়ে বেশি। এর বাইরের পরিসংখ্যান এখনও আমাদের সামনে আসেনি। আমার মনে হয় তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা এই মুহূর্তে আমাদের তরুণ প্রজন্ম বা কিশোর-কিশোরীরা কোন কোন মাধ্যমে বেশি আসক্ত সেই পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করতে পারেন। একটু রুচিবান কিশোরদের পছন্দ স্ন্যাপচ্যাট ও ইনস্টাগ্রাম। সেখানে তারা প্রাইভেসি মেইন্টেইন করে নিজের অ্যাকাউন্ট চালাতে পারে। এই একটা জায়গা আমাদের দৃষ্টির বাইরেই রয়ে গেছে। তবে বড় একটা অংশ বর্তমানে ‘টিকটক’ নামের একটি অ্যাপে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
টিকটক সৃষ্টি চাইনিজদের হাত ধরে। মূলত অ্যামিউজমেন্ট প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই এই টিকটকের জন্ম। একদম প্রথম থেকেই টিকটক ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং এর ইউজার সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তেই থাকে। বিশ্বায়নের কালে কোনোভাবেই আমাদের সন্তানদের ইন্টারনেটের দুনিয়া থেকে আলাদা করতে পারবো না। কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে ভালোমন্দের শিক্ষা ব্যতীত আমাদের সন্তানেরা আসক্ত হয়ে পড়ছে।
টিকটক একপ্রকার আসক্তির পর্যায়েই চলে গেছে। এই অ্যাপটিতে তথ্যপ্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ কতটা আছে জানি না, তবে তথ্যের সিকিউরিটি ইস্যুতে ভারতসহ অনেক দেশ এর ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইতোমধ্যে। আমাদের দেশের হাইকোর্টও একটা গাইডলাইন দিয়েছেন, কিন্তু ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়নি।
আমি জানি, আমাদের নতুন প্রজন্ম আমার ওপর রাগ করতে পারে। আমি মূলত টিকটক নিয়ে চিন্তিত নই। আমি বেশি চিন্তিত আমাদের কিশোর প্রজন্ম এই টিকটকের প্রতি যে আসক্তি প্রকাশ করছে সেটি নিয়ে। টিকটক করতে গিয়ে তারা নিজেদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
টিকটক করতে গিয়ে এক তরুণী ফাঁসির দড়িতে আটকে মারা গেছে। কারণ, সে ফাঁসির একটি দৃশ্যায়ন করতে চেয়েছিল কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেই দড়িতে নিজেই আটকে মৃত্যুবরণ করে। আরেকজন তরুণ ব্রিজের ওপর থেকে লাফ দিয়ে টিকটকের জন্য ভিডিও করতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে। ফেসবুকে একটি ভিডিও দেখলাম, এক তরুণী রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে টিকটকের ভিডিও করতে গিয়েছিল এবং ঠিক সেই সময়েই রেলগাড়ি চলে আসে এবং সে বুদ্ধি করে রেললাইনের মাঝের ফাঁকা জায়গায় শুয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষা করেছে।
এই যে বিপজ্জনক নেশা, এর থেকে রক্ষা করার উপায় নিয়ে আমাদের ভাবার সময় এসেছে। আমাদের প্রজন্ম এমনিতেই বিভ্রান্তিতে আছে। সমাজে নেই কোনও আদর্শিক চর্চা। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন এখন হয় না বললেই চলে। পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব চর্চা নেই। আগে ক্লাবগুলো থেকে বিভিন্ন খেলার টুর্নামেন্ট ঘোষণা করা হতো। বিভিন্ন বিতর্ক বা গান বা নাচের প্রতিযোগিতা হতো। সেসবের জায়গায় এখন প্রতিভা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে আমাদের সন্তানেরা বেছে নিয়েছে টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মকে। এই প্ল্যাটফর্মে তাদের কোনও কসরত করতে হয় না। অ্যাপ ব্যবহারের সামান্য কিছু কৌশল শিখে গেলেই রাতারাতি ফেইম বা খ্যাতি পাওয়া যায়। প্রচুর লাইক, কমেন্ট বা ফলোয়ার পাওয়া সম্ভব। যাদের তথাকথিত সামাজিক টার্মে বলা হয় “সেলিব্রিটি”।
এই ধরনের টিকটক সেলিব্রিটিদের ফাঁদে পড়ে আমরা নারী ধর্ষণ বা নারীপাচারের মতো ঘটনারও সাক্ষী হয়েছি। স্বল্প পরিশ্রমে বিখ্যাত হওয়ার লোভ আমাদের ছেলেমেয়েদের দিশেহারা করে দিচ্ছে। তারা ভুলে যাচ্ছে এভাবে বিখ্যাত হয়ে বাস্তবে তাদের জীবনের দীর্ঘমেয়াদি কোনও অর্জন যুক্ত হবে না। কেউ কেউ হয়তো এখান থেকে নিজের আয় রোজগারের একটা রাস্তা বের করতে পারছে, কিন্তু বেশিরভাগই ফাঁদে আটকে যাচ্ছে। এই তো কদিন আগে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে টিকটকারদের কর্মকা- প্রত্যক্ষ করলাম আমরা। ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানা যায়, এক টিকটকারের বাবা-মারা যাওয়ার পর লাশের আশপাশে ঘুরে ঘুরে নাচতে নাচতে সে টিকটক করে আপলোড করে প্রচুর ফলোয়ার অর্জন করেছে। এভাবে টিকটক সেলিব্রিটিরা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, মানবিকতা সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিচ্ছে।
ছেলেমেয়েরা এখন প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই প্রযুক্তিজ্ঞান কতটা সঠিক রাস্তায় ব্যবহৃত হচ্ছে সেটিও ভেবে দেখা দরকার। প্রযুক্তির খারাপ দিকটি না জেনে কেবল ব্যবহার শিখলেই তাকে আগানো বলে না।
আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় টিকটক থেকে ভিডিও মুছে দেওয়ার তথ্য পাই, কিন্তু এভাবে কেবল ভিডিও মুছে দেওয়াতেই সমাধান আসবে না। টিকটকের ব্যবহারবিধি সম্পর্কেও আমাদের জানতে হবে। আমাদের তারুণ্য আজ একদিকে মৌলবাদের খপ্পরে পড়ে এক ধরনের বায়বীয় জ্ঞান নিয়ে বাড়ছে। আবার আরেকদিকে একটি বড় অংশ টিকটকের মতো একটি মাধ্যমের অপব্যবহারের জ্ঞান নিয়ে এগোচ্ছে। বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকটিও এখন বিশ্বস্বীকৃত। কিন্তু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের জায়গাটিকে যদি এখনই আমরা সচেতনভাবে নজর না দেই তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে বাংলাদেশের আজকের এই শক্ত অবস্থান সঠিক তদারকিতে থাকবে বলে মনে হয় না।
তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন, আমাদের সন্তানদের বাঁচান। তারা এক ধরনের ইলিউশনের মধ্যে বেঁচে আছে। চাকচিক্য আর রাতারাতি খ্যাতি পাওয়ার জৌলুস তাদের মরণের দিকে টেনে নিচ্ছে। প্রযুক্তিকে বন্ধ করে নয়; বরং এর অপব্যবহারকে লাগাম দিয়েই সমাধানের রাস্তাটি খুঁজতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট।