শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:৫৬ am
রাজনীতিতে অনেকরকম কথা হয়, অনেক স্লোগান দেওয়া হয়। সব কথা, সব স্লোগান সব সময় বিবেচনায় নেওয়া হয় না, নেওয়া সম্ভবও নয়। রাজনীতিতে হুমকি-পাল্টা হুমকি সব আমলে নিলে রাজনীতিই থাকবে না। আমাদের ছাত্রজীবনজুড়ে দেশের ওপর চেপে বসেছিল এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসন। তখনকার কিছু স্লোগান মনে হলে এখন হাসি পায়। ‘এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি’ এই স্লোগান বাস্তবায়িত হতে ৯ বছর সময় লেগেছিল।
এরশাদের আমলে সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘এরশাদের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’। কিন্তু এরশাদের পতনের পরও তার দুই গালে কেউ জুতা মারতে যায়নি। ‘একটা দুইটা শিবির ধর, সকাল-বিকাল নাস্তা কর’ এমন অবাস্তব ও অকল্পনীয় স্লোগানও বেশ জনপ্রিয় ছিল। ছাত্রশিবির ক্যাডাররা প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের ধরে হাত-পায়ের রগ কাটলেও তাদের ধরে কেউ নাস্তা করেনি। প্রতিপক্ষকে ‘নির্মূল’ করার আকাঙ্ক্ষা থাকে সবারই। কিন্তু এই ‘নির্মূল’ মানে কিন্তু হত্যা নয়, প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করার আকাঙ্ক্ষাই থাকে সবার মনে।
১৫ আগস্ট সরাসরি না হলেও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টার দায় পুরোটাই বিএনপির। বিএনপি বারবার প্রমাণ করেছে, স্বচ্ছ রাজনীতি নয়, হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রেই তাদের আস্থা। ’৭৫-এর হাতিয়ার আরেকবার গর্জে তোলার স্লোগান বিএনপি-ছাত্রদলের মনের ভেতরে লালন করা আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ। পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে তোলার স্লোগান কোনোভাবেই রাজনীতি নয়।
২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের মূল স্লোগান ছিল ‘ফাঁসি চাই’। অনেকে এই স্লোগানকে নিষ্ঠুর বলেছেন। এই স্লোগানের মাধ্যমে কিন্তু সবার ফাঁসি চাওয়া হয়নি। যারা একাত্তরে হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের মতো সুনির্দিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে; আইনি আদালতের মাধ্যমে তাদের সর্বোচ্চ সাজা চাওয়া হয়েছে। ’৭১ সালে তারা যে নিষ্ঠুরতা করেছে, সে তুলনায় তাদের ‘ফাঁসি চাওয়া’ মোটেই নিষ্ঠুরতা নয়। গণজাগরণ মঞ্চ দাবি করলেও আদালত কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণ দেখে রায় দিয়েছেন, অভিযুক্ত সবার ফাঁসি দেননি।
গত একযুগে বিএনপি নেতারা যত হুঙ্কার দিয়েছেন, তার এক শতাংশও বাস্তবায়ন করা গেলে অনেক আগেই আওয়ামী লীগ সরকারেরপতন ঘটে যেতো। ‘ঈদের পর আন্দোলন’ তো এখন রাজনৈতিক ট্রলের বিষয়। কিন্তু রাজনীতি এমনই। কথার লড়াই চলতেই থাকবে। এক পক্ষ আরেকপক্ষকে কাবু করতে চাইবে। এটাই রাজনীতির কৌশল।
কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পদ্মা সেতু থেকে টুস করে ফেলে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। এই মন্তব্য নিয়ে রাজনীতিতে তোলপাড় চলছে। বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে খালেদা জিয়াকে ‘হত্যার হুমকি’ বলে মন্তব্য করেছে। শেখ হাসিনা কি সত্যি সত্যি খালেদা জিয়াকে পদ্মা সেতু থেকে টুস করে ফেলে দিতে চেয়েছেন? এটা হলো রাজনীতির বাত কি বাত।
বিশ্বব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি শত ষড়যন্ত্র উড়িয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা যখন অসীম সাহসিকতায় নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু বানানোর উদ্যোগ নেন, তখন খালেদা জিয়া উপহাস করে বলেছিলেন ‘জোড়াতালি’ দিয়ে পদ্মা সেতু বানানো হচ্ছে। খালেদা জিয়ার ‘জোড়াতালি’তত্ত্ব যেমন রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর, শেখ হাসিনার টুস করে ফেলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষাও তেমনি। এখন সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে, আইনি জটিলতা না থাকলে খালেদা জিয়াকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে। ওবায়দুল কাদের নিশ্চয়ই টুস করে ফেলে দেওয়ার জন্য খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানানোর ইচ্ছার কথা বলেননি। আবার বিএনপি যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ‘হত্যার হুমকি’ হিসেবে দেখছে, সেটাও রাজনৈতিকই।
তবে এতসব রাজনৈতিক স্লোগান-পাল্টা স্লোগান, হুমকি-পাল্টা হুমকির মধ্যে একটি স্লোগান রাজনীতির বাইরে চলে গেছে। বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ স্লোগান দিয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়েছে। এই স্লোগানের পরিণতিতে ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দফায় দফায় মার খেয়েছে।
ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলার নিন্দা আমি আগেও করেছি। আমি বিশ্বাস করি গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার স্বার্থেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের শান্তিপূর্ণ নিশ্চিত করাটা জরুরি। ছাত্রদল যদি বেআইনি কিছু বলে থাকে, সরকারের দায়িত্ব তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার। ছাত্রলীগ পুলিশ নয় যে, তারা কাউকে শাস্তি দেবে। ছাত্রলীগ যদি সব অন্যায়ের প্রতিকার করে, তাহলে আর দেশে সরকার থাকার দরকার কি। ছাত্রলীগের আইন হাতে তুলে নেওয়া মানে কিন্তু সরকারের প্রতি অনাস্থা জানানো। আপনি স্লোগান দিতে পারবেন, পাল্টা স্লোগান দিতে পারবেন; কিন্তু আইন হাতে তুলে নিতে পারবেন না।
তবে ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠা’র স্লোগান শুধু ছাত্রলীগ নয়, আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাবে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বিপথগামী সেনা সদস্যরা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে দায়ী করে। এটা ঠিক ১৫ আগস্টের ঘটনার মূল সুবিধাভোগী জিয়াউর রহমানই। আওয়ামী লীগ যতই বলুক, বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জিয়াউর রহমানের সরাসরি জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। অন্তত ১৫ আগস্টের ঘটনায় জিয়াউর রহমান বেনিফিট অব ডাউট পাবেনই। আর বিএনপির তো তখন জন্মই হয়নি। তাই ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক দায়ও বিএনপির কাঁধে দেওয়ার সুযোগ নেই।
তবে খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্বাসন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার সুযোগ বন্ধ রেখে জিয়াউর রহমান আগ বাড়িয়ে অনেকটা দায় নিজের কাঁধে টেনে নিয়েছিলেন। আর খালেদা জিয়া ’৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর হঠাৎ ১৫ আগস্ট নিজের জন্মদিন আবিষ্কার ও ঘটা করে তা পালনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক দায়টা আসলে বিএনপি ধারণ করে।
১৫ আগস্ট সরাসরি না হলেও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টার দায় পুরোটাই বিএনপির। বিএনপি বারবার প্রমাণ করেছে, স্বচ্ছ রাজনীতি নয়, হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রেই তাদের আস্থা। ’৭৫-এর হাতিয়ার আরেকবার গর্জে তোলার স্লোগান বিএনপি-ছাত্রদলের মনের ভেতরে লালন করা আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ। পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে তোলার স্লোগান কোনোভাবেই রাজনীতি নয়। লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।