শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:১০ am
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)সহ বিভিন্ন গণমাধ্যম যখন নিত্যপণ্যের অতিরিক্ত দাম ও অতিমুনাফা লাভের কথা বলা হচ্ছিল, তখন কিছু কিছু ব্যবসায়ী নেতাদের ঘোর আপত্তি। তাদের হাজারো যুক্তি। অধিকন্তু সরকারের বিভিন্ন মহল থেকেও ব্যবসায়ীদের যুক্তিকে সমর্থন করে বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছিল। চিনি, পেয়াঁজ, ভোজ্যতেল, মসলার কারসাজির পর কাপড়ের দোকান সর্বশেষ বাস কাউন্টারগুলিতে ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানের পর দেখা গেলো তার স্বচিত্র প্রতিবেদন। কারসাজি, অতিমুনাফা ও ভোক্তার পকেট কাটা কাকে বলে? এখন সেকারনে আমরা দেখছি অনেকে বলা শুরু করছে ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যদিও এর আগে কিছু লোকজন ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেছিলেন। যদিও সরকার ভোক্তাদের স্বার্থে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, বিটিআরসিসহ নানা কর্তৃপক্ষ গঠন করছেন।
আমরা দেখি রমজান মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশের ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের জন্য মূল্য ছাড় দেন। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলিতে বড় দিন উপলক্ষে এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে পুজার সময় এভাবে মূল্য ছাড়ের রীতি চলমান। অথচ তার বিপরীত চিত্র আমাদের দেশে, দাম কমাতো দূরের কথা ভিন্ন মাত্রায় প্রতারণরা করে অতি মুনাফা লাভে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা। হোটেল রেস্তোরায় অস্বাস্থকর পরিবেশের ইফতারি তৈরী ও বিক্রি, বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে সেমাই, ঘি তৈরি, বেশি দামে মাংস ও বাসের টিকিট বিক্রির মতো অনৈতিক কাজে বেপরোয়া ব্যবসায়ীরা। এমনকি বিশ্ববিখ্যাত জুতার কোম্পানি বাটা, দেশীয় এপেক্স জুতায় নতুন সিল মেরে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এভাবে খাদ্য, জামাকাপড়, প্রসাধনী থেকে শুরু করে গণপরিবহনে যাতায়াতের ক্ষেত্রেও ভোক্তাদের ঠকাতে মারমুখি অসাধু ব্যবসায়ীরা। যা গণমাধ্যমের কারণে সকলের গোছরীভুত হয়েছে। এসব অসাধু তৎপরতা অপতৎপরতা ঠেকাতে ভোক্তা সংরক্ষন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশনের বাজার অভিযান পরিচালনা করছে। অপরাধের জন্য আদায় করা হচ্ছে জরিমানা, করা হচ্ছে সতর্ক। কিন্তু তারপরও অসাধু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ২০ এপ্রিল রাজধানীর কদমতলী থানাধীন জুরাইন-পোস্তগোলা এলাকার আলম সুপার মার্কেটে আবদুস সাত্তার সুজ নামের কারখানায় বাটা, এপেক্সসহ নামি-দামি ব্র্যান্ডের লোগোর আদলে নকল লোগো দিয়ে স্যান্ডেল তৈরি করছে। এপেক্স হয়ে গেছে এডেক্স ও বাটা হয়েছে বালা। এ ছাড়া এপেক্সের লোগো হুবাহু নকল করা হচ্ছে। কারখানাটির কোনো ধরনের অনুমোদন ও ট্রেড লাইসেন্সও নাই। একইভাবে রাজধানীর মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে দেখা যায় ১৭শ টাকার শাড়ি ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন দোকানে ইচ্ছামতো স্টিকার দিয়ে দাম নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। আবার কোন ক্রয়ের রশিদ নাই, বিক্রির রশিদও দেয়া হয় না। এর বাইরে অভিনব কায়দায় প্রতারনা দেখা দেখা যায় নিউমার্কেটের ইরো ইথিক ওয়ার নামে পাঞ্জাবির দোকানে। পাঞ্জাবির প্রকৃত দাম ১ হাজার ১৯০ টাকা। মূল্য ছাড়ের নামে সেই পাঞ্জাবির দাম লাগানো হয়েছে ২ হাজার ৪৯০ টাকা। এই মূল্যের ৫০ শতাংশ ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু স্টিকারের নিচে আরেকটি স্টিকার লাগানো রয়েছে। সেখানে মূল্য লেখা রয়েছে ১ হাজার ৭৯০ টাকা এবং এর নিচে আরও একটি স্টিকার রয়েছে। সেখানে মূল্য লেখা রয়েছে ১ হাজার ১৯০ টাকা।
শুধু পোশাকের ব্যবসায়ীরা নয়, ইফতারির আইটেম ও খাদ্যের ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে অসাধু ব্যবসায়ীরা দ্বিধারোধ করছে না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ধানমন্ডির মিরপুর রোডে রস মিষ্টির সৃষ্টি খাদ্য পরিবেশন করতে দেদারসে। অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতারণা শুধু পণ্যের মূল্য পুনর্র্নিধারণ কিংবা খাদ্যে ভেজালই নয়; প্রতারণা চলছে খাদ্যে রং মিশিয়ে, মরা মাছে গরুর রক্ত মিশিয়ে, মহিষের মাংসকে গরু এবং কুকুরের মাংসকে খাসির মাংস বলে, পুকুরের মাছকে নদীর মাছ বলে। প্রতারণা আছে পোড়া মবিল দিয়ে ভাজাপোড়া করা, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বেচাকেনা করা, রডের পরিবর্তে বাঁশের কঞ্চি এবং সিমেন্টের স্থলে বালি ব্যবহার করা ইত্যাদি। ঈদ না আসতে না আসতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই ব্যবসাও জমজমাট করতে মেতে উঠেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে ওজন ও সঠিক মাপ না দেওয়ায় অভিযোগও কম নয়।
অব্যাহত প্রতারণার সঙ্গে নতুন করে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে পণ্যের নির্ধারিত মূল্যে ঘষাঘষি করে নতুন মূল্য লিখে দেওয়া। বিভিন্ন উৎসব, বিশেষ করে ঈদ সামনে রেখে পণ্যের মূল্যের হরহামেশা পরিবর্তন করা। একই পণ্যের ওপর একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার পরিবর্তন করে নতুন মূল্য স্টিকার লাগানোর ঘটনা ঘটছে। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে গ্রাহকদের কষ্টের টাকার এই জলাঞ্জলি, কষ্টের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বেশকিছুদিন ধরেই অনলাইন পণ্য সরবরাহ এবং মূল্য পরিশোধের যে ভয়াবহ প্রতারণা আমরা দেখেছি। মূল্য পরিশোধ করার পরও দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও পণ্যটি আসেনি কিংবা যে পণ্য দেওয়ার কথা তা না দিয়ে নিম্নমানের অন্য কিছু পাঠিয়ে দেবার ঘটনাও কম নয়। আবার কোনো কিছু না দিয়েই টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করে উধাও হয়ে গেছে। এসব হায় হায় ই-কমার্স কোম্পানির কিছুকিছু আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা চিহ্নিত করতে পারলেও ভুক্তভোগী মানুষের দুর্ভোগ কমে নাই।
শুধু খাবার বা জামা-কাপড়ে অতিমুনাফা ও প্রতারণা নয়, ঈদকে সামনে রেখে গণপরিবহনে যাতায়াতের বাসগুলিও ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করতে দ্বিধাবোধ করছে না। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর কল্যাণপুর ও গাবতলীতে এবং দেশব্যাপী বিভিন্ন বাস কোম্পানীর কাউন্টারে অভিযান পরিচালনা করে অনিয়মের জন্য সর্তকতা ও জরিমানা করেছেন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনায় পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা, মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি, নির্ধারিত তালিকার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি, নকল পণ্য প্রস্তুত করা, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রিসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তিমুলক জরিমানা করছে। এর বাইরে খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআইও বাজারে ওজনযন্ত্রের ভেরিফিকেশন সনদ হালনাগাদ না থাকা, পণ্য মোড়কজাতকরণ সনদ প্রদর্শনে ব্যর্থতার অপরাধে জরিমানা করছেন।
একথা সত্য যে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তারপরও রমজানকে কেন্দ্র করে অনেক মুসলিম দেশে পণ্যের দাম কমিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে রমজান মাস এলেই খাদ্য-পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ে। অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ীর আর্ভিবাবও ঘটে। আবার অনেকে মনে করে থাকেন রমজানে একমাস ব্যবসা করবো ১১ মাস বসে থাকবো। যার কারণে মহামান্য রাষ্ট্রপতিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অসাধু ব্যবসায়ীদের এসব কারসাজিকে আল্লাহর গজব বলে উল্লেখ করেছিলেন। ইসলামের দৃষ্টিতে পণ্য মজুত ও অতিমুনাফাকে সমর্থন করেনি। কিন্তু ধর্মীয় এসব বানী সত্বেও কে শুনে কার কথা। রমজানে রোজা রেখেও অনেক ব্যবসায়ী মুল্য কারসাজি, মজুতদারি, কৃত্রিম পণ্য সরবরাহ সংকট তৈরীতে বিরত থাকছে না। বাজারমূল্যের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে প্রতিটি পণ্যের ক্রয় এবং বিক্রয় মূল্যের চার্ট ঝুলিয়ে রাখার জন্য ভোক্তা সংরক্ষন আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা অনেকেই মানছেন না।
এ অসাধু ব্যবসায়ীদের ভিত এতই শক্তিশালী যে সরকারী প্রশাসন যন্ত্র মনে হয় তাদের কাছে অসহায়, এরা টাকার জোরে সরকারি আমলা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিভিন্ন মিডিয়াকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন। বরং এরকম জলজ্যান্ত মানুষ মেরে কোটিপতি হবার লোকের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। ইতঃপূর্বে একই কায়দায় গুড়োদুধে ময়দা মিশ্রিত করার হোতাসহ চিনি, সয়াবিন, চাল কেলেংকারী হোতাদের কোন শাস্তি হয়নি। তারা পর্দার আডালে আবার রেহাই পেয়ে যায়। আর সাধারন ভোক্তা হিসাবে জনগন অসচেতন ও অসংগঠিত, ভোক্তার অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা, ভোক্তা সংগঠনগুলিকে সরকারি উপেক্ষার কারণে প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে ভেজাল ও নিন্মমানের খাদ্যের বাজার ও পরীক্ষাগারে পরিণত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ফলে মানুষ যা আয় রোজগার করছে তার সিংহভাগই ওষুধ ও চিকিৎসার খরচ যোগাতে চলে যাচ্ছে। সরকার ও বহু জাতিক দাতা সংস্থা গুলি ব্যবসায়ী ও চেম্বারগুলিকে নানা সুবিধা দিলেও ভোক্তাদের সচেতন করার জন্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে দেশে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মধ্যে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যা ব্যবসায় সুস্থ ধারা বিকাশে বিশাল প্রতিবন্ধক।
ব্যবসা শুধুমাত্র একটি অর্থ উপার্জনের উপায় নয়, এটা একটি সেবাও বটে। যার মাধ্যমে একজন ব্যবসায়ী ভোক্তাকে খাদ্য-পণ্য ও সেবা সার্ভিস দিয়ে সেবাও করছেন। পণ্যের মূল্য ঘষামাজা করে অতিমুনাফা আদায়ে সচেষ্ঠ হওয়াকে ব্যবসা বলা যাবে না। এটা প্রতারনা আর এই প্রতারনা ফৌজদারী অপরাধও বটে। তবে আইন দিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সব সময় সম্ভব না ও হতে পারে। এজন্য প্রয়োজন অতিমুনাফালোভী, প্রতারক, মজুতকারী ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সামাজিক ভাবে বয়কট করা। তাহলেই হয়তো ব্যবসা-বানিজ্যে জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত হবে।
লেখক: এস এম নাজের হোসাইন, ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।